বাবা যখন অফিস থেকে ফোন দিয়ে বললেন,
- মা রে, আজ একটু টেংরা মাছের ঝোল রান্না করতে পারবি? খেতে ইচ্ছে করছে খুব।

প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিলাম। এমনিতেই সকাল থেকে লিমনের সাথে ঝগড়া চলছে। মন মেজাজ একদম ঠিক নেই। তার উপর আবার এই রান্নাবান্নার উটকো ঝামেলা। মা তো মরে গিয়ে বেঁচে গিয়েছেন। আমাকে রেখে গিয়েছেন রাত-দিন ২৪ ঘন্টা বাবা'র কামলা খাটার জন্য। যাই হোক যথেষ্ট অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও রান্নাঘরে গেলাম টেংরা মাছের ঝোল রান্না করতে। রান্না করতে করতেই লিমন কে একনাগাড়ে ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছিলাম। নাহ, ফোন ধরছে না লিমন। ছেলে টা আজকাল খুব অদ্ভূত আচরন করছে। কথায় কথায় ভুল ধরে, অযথা সন্দেহ করে, আর পান থেকে চুন খসলেই বিশ্রীভাবে গালিগালাজ শুরু করে দেয়। আজকে আবার ব্রেকআপের ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু এ তো অসম্ভব। বড্ড বেশি ভালবেসে ফেলেছি লিমন কে। ওকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকার কথা ভাবতেই পারি না। এসব ভাবতে ভাবতেই কোনমতে রান্না শেষ করলাম। তাড়াতাড়ি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে লিমনের বন্ধু সাজ্জাদ ভাইয়ার কাছে কল দিলাম। সাজ্জাদ ভাইয়া বললেন,
- দেখো মান্নাত, লিমন এখন প্রচন্ড ক্ষেপে আছে। তুমি কাল রাতে ওকে এতবার কল দিয়ে ডিস্টার্ব করে ঠিক করো নি।
- কিন্তু ভাইয়া, ও তো ওয়েটিং এ ছিল। আমার কি এতটুকু জানার অধিকার নেই ও কার সাথে এত রাতে কথা বলছিলো?
- এটা তোমাদের ব্যাপার। তারপরও আমি লিমন কে বলছি, তোমার কল রিসিভ করতে। শুনবে কিনা জানি না। তবে এখন ওর মতের বাইরে আর কিছু করো না। যা বলে শুনে নিও।
- ঠিক আছে।
কিছুক্ষণ পর লিমন কে কল করলে সে রিসিভ করলো,
- শুনো মান্নাত, আমি শুধু সাজ্জাদের কথায় তোমার কল রিসিভ করেছি। আমি তোমাকে একটা লাস্ট চান্স দিচ্ছি।
- এভাবে কেন কথা বলছো লিমন?
- তুমি কি আমার সব টা কথা শুনবে?
- আচ্ছা বলো।
- তুমি কাল আমার সাথে সাজ্জাদের ফ্ল্যাটে যাবে।
- ওখানে কেন?
- এতদিন হয়ে গেল আমাদের রিলেশনশিপ চলছে। অথচ আজ পর্যন্ত আমি তোমাকে নিজের করে পেলাম না। আমার কি কোন ইচ্ছে থাকতে পারে না?
- কিন্তু লিমন...
- কোন কিন্তু নয়, যা বলছি তাই। আর একটা কথা, আসার সময় ৩ হাজার টাকা নিয়ে আসবে।
- গত সপ্তাহেই না তোমাকে ১৫০০ টাকা দিলাম!
- এত প্রশ্ন কেন করছো? তুমি মনে হয় ফাইনালি ব্রেকআপ-ই চাচ্ছো।
- না না, ঠিক আছে আমি নিয়ে আসবো।
ঠুস করে লাইন টা কেটে দিলো লিমন। এতক্ষণে আমি একটু শান্তি পেলাম। কিন্তু টেনশন তো থেকেই গেল, ৩০০০ টাকা কোথায় পাবো!

সন্ধ্যায় বাবা একরাশ ক্লান্তি নিয়ে অফিস থেকে ফিরলেন। এসেই ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন,
- মান্নাত, কোথায় গেলি মা? দেখ্, তোর জন্য কি নিয়ে এসেছি।
- কি হয়েছে বাবা? এত চেঁচাচ্ছো কেন?
- আজকে চেয়ারম্যান স্যার সবাইকে খাইয়েছেন,ছেলে বুয়েটে চান্স পেয়েছে তাই। খাবার টা তোর জন্য নিয়ে এলাম। তুই তো চাইনিজ খাবার পছন্দ করিস খুব।
- কই দেখি দেখি।
বাবাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি খেতে বসে গেলাম। বাবা কে এক কাপ চা ও সাধলাম না।
পেট পূজো করে এসে খুব আয়েশ করে ভাবছি কাল কি কালারের শাড়ি পরবো, লিমনের সামনে কিভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করবো। হঠাৎ করে মাথায় আসলো, ৩০০০ টাকা বাবার কাছে চাইলেই তো হয়। আমার কোন চাওয়া কি বাবা অপূর্ণ রাখেন! এর মধ্যেই বাবা আবার ডাকলেন,
- মা রে, ভাত দিয়ে দে আমাকে।
এই তো সুযোগ। খাবার টেবিলে বাবার কাছে টাকার কথা বলা যাবে।
বাবার সামনে ভাত বেড়ে দিয়ে আমি আবার রুমে চলে এলাম। ভাবছি, কোন অজুহাতে টাকা টা চাইবো।
বাবার কাশির শব্দ শুনে বিরক্তি নিয়ে পানি দিতে গেলাম। তারপর বললাম,
- এভাবে খাচ্ছো কেন? আস্তে আস্তে খাও।
বাবা একটু লাজুক ভংগী তে উত্তর দিলেন,
- দুপুরে কিছু খাই নি তো। তাই খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। আর তরকারি তে ঝাল টা একটু বেশি লাগছে কিন্তু খেতে খুব ভাল হয়েছে।

বাবা দুপুরে কিছু খান নি শুনে আমি যেন থমকে গেলাম। তার মানে বাবা নিজে না খেয়ে আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন! অথচ দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত দিব্যি অনাহারে কাটিয়ে দিলেন। আর বাবা যে ঝাল একদম খেতে পারেন না, তাড়াহুড়োর মধ্যে এটা তো আমার মাথায় ই ছিল না। আমার ভেতর টা কেমন যেন করে উঠলো। অল্প একটু কোন মতে গিলে বাবা খাওয়া শেষ করলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম, বাবার খেতে কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলেন নি।
কিছুক্ষণ পর বাবার কাছে গিয়ে বললাম,
- আমার কাল ৩০০০ টাকা লাগবে, বাবা।
বাবার মুখটা নিমিষেই চুপসে গেল। বুঝতে পারছিলাম বাবার হাতে এখন কোনো বাড়তি টাকা পয়সা নেই। থাকবেই বা কি করে! আজ মাসের ২৫ তারিখ।
কিন্তু বাবা আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে বলে দিলেন,
- ঠিক আছে, সকালে নিয়ে নিস।
আর কোন প্রশ্ন করেন নি বাবা। মা মারা যাওয়ার পর থেকে এই বাবাই আমাকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছেন। আদর-যত্নের কোন কমতি রাখেন নি। যখন যা চেয়েছি তাই পেয়েছি সবসময়। বেশিরভাগ সময় বাবা তাঁর সাধ্যের বাইরে গিয়ে আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন। বিনিময়ে আমি কি কিছু করতে পেরেছি বাবার জন্যে? এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি তে দুটো জিপিএ.৫ ছাড়া আর কিছুই দিয়ে উঠতে পারি নি বাবা কে এ পর্যন্ত। কিন্তু এসব ভেবে এখন সময় নষ্ট করতে একদম ইচ্ছে করছে না।

ডাইনিং টেবিল গুছানোর সময় শুনতে পেলাম, বাবা ফোনে কাকে যেন বলছেন,
- আমার সিরিয়াল টা ক্যান্সেল করে দিন। অফিসে কাল কাজের চাপ আছে। তাছাড়া এখনি ডক্টর দেখানো টা জরুরী না।
স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বাবার বুকের ব্যথা টা নিশ্চয়ই আবার বেড়েছে। কিন্তু আমাকে বুঝতে দেন নি,আর আমিও হয়তো বুঝতে চায় নি। ৩০০০ টাকা যে বাবা চিকিৎসার জন্য রেখেছিলেন,তাও বুঝতে অসুবিধা হল না। খুব ছোটখাটো একটা চাকুরী করেন বাবা। মাসজুড়ে সংসারে টানাটানি চলতেই থাকে। এই স্বল্প আয়ের মধ্যে আমার চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রায়ই বাবা হাঁপিয়ে উঠেন।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে লিমন কে টেক্সট করলাম, "সকাল ১১ টায় প্রথমে পার্কে চলে আসবে"।
সকালে বাবা অফিসে যাওয়ার আগে আমার হাতে ৩০০০ টাকা দিয়ে গেলেন। ঠিক সকাল ১১ টায় সবুজ কালারের একটা শাড়ি পড়ে হালকা সেজে পার্কে পৌঁছে গেলাম। লিমন আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। আমি লিমনের সামনে যেতেই লিমন ভ্রু কুঁচকে বললো,
- আর কোন কালার পেলে না? জানো না,সবুজ আমি একদম সহ্য করতে পারি না।
আমি শুধু একটু মুচকি হাসলাম। খানিক বাদে লিমন আবার বললো,
- ঠিক আছে, চলো এখন। আর টাকা টা এনেছো?
আমি আচমকা লিমনের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। লিমন হতভম্ব হয়ে গেল। গালে হাত দিয়ে এক দৃষ্টি তে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি স্বাভাবিক ভঙ্গি তে বললাম,
- এ পর্যন্ত আমার কাছ থেকে যত টাকা হাতিয়েছিস, এক্ষণি সব ফেরত দিবি। নয়তো প্যান্ট শার্ট খুলিয়ে তোকে রাস্তায় নামিয়ে দিবো। আমার কাছে তোর সব অশ্রাব্য গালিগালাজ আর কুপ্রস্তাবের রেকর্ডিং আছে। এগুলো নিয়ে পুলিশের কাছে গেলে তোর কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছিস?
- মান্নাত, কি বলছো এসব? ঠান্ডা হও প্লিজ।
- একদম আমার গায়ে হাত দিবি না। আমি কিন্তু লোক জড়ো করবো। টাকাগুলো ফেরত দে।
অবশেষে লিমন তার ক্রেডিট কার্ড আমার কাছে জমা দিয়ে মান-ইজ্জত নিয়ে পালাতে বাধ্য হল।
আমি সোজা বাবার অফিসে চলে গেলাম। সবুজ রঙ বাবার খুব পছন্দের। বাবা আমাকে দেখে খুব অবাক হলেন, একইসাথে খুশিও হলেন। সেখান থেকে ছুটি নিইয়ে বাবা কে বগলদাবা করে প্রথমে হসপিটালে গেলাম। কিন্তু ডক্টর আজকে আসেন নি বলে বাবার চেকআপ করাতে পারলাম না। হসপিটাল থেকে বের হয়ে চলে গেলাম শপিংমলে। বাবা কে দুটো নতুন শার্ট আর একটা প্যান্ট কিনে দিলাম। তিনটে পুরনো শার্ট আর দুটো প্যান্ট দিয়ে বাবা চারটে বছর চালিয়ে নিয়েছেন। শার্ট প্যান্ট কেনার সময় বাবা বারবার বলছিলেন,
- আমার তো এসব আছে সব। শুধু শুধু টাকা নষ্ট করছিস। এ টাকা দিয়ে বরং তোর জন্যে কিছু কিনে নে। গত ঈদের পর থেকে এ পর্যন্ত তোকে কোনো ড্রেস কিনে দিতে পারি নি। প্রতিদিন ভার্সিটি যাস, নতুন ড্রেস লাগে তো।
প্রতিউত্তরে আমি বাবা কে জিজ্ঞেস করলাম,
- তুমিও তো প্রতিদিন অফিসে যাও, তোমার বুঝি লাগে না?
মৃদু হেসে বাবা উত্তর দেন,
- বাবাদের এত কিছু লাগে না রে, বুঝলি?
আমি আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাই নি।
বাবা কে একজোড়া জুতোও কিনে দিলাম কম দামের মধ্যে। এখন যে জুতো টা পরে আছে, এটার জায়গায় জায়গায় সেলাইয়ের দাগ আছে। কমপক্ষে পাঁচবার এটাকে মুচির কাছে নেয়া হয়ে গেছে।
আমার কাছে কিছু জমানো টাকা ছিল। লিমনের জন্মদিনে উপহার দেবো বলে জমিয়েছিলাম। এই টাকা দিয়ে বাবা কে রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খাওয়ালাম, রেস্টুরেন্টে বসে বাবা আমাকে খাইয়ে দিলেন। বাচ্চাদের মত বাবা আনন্দে ছটফট করছিলেন। বাবা কে এত খুশি হতে আগে কখনো দেখি নি আমি। বাবা হয়তো কোনো দিন ভাবতে পারেন নি, আমি আমার গোটা একটা দিন বাবাকে কখনো দিতে পারবো। হয়তো আমার কাছ থেকে এতটুকুও আশা করেন নি। অথচ তিনি কিন্তু তার পুরো টা জীবন আমার নামে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। ডিনার সেরে রিক্সা করে বাসায় ফেরার সময় বাপ-মেয়ে আইসক্রিম খেলাম। আজকের দিন টা ছিল আমার "বাবা-বিলাসের" দিন।
ভালবাসা ভালবাসা করে আমরা প্রতিনিয়ত ভুল দরজায় কড়া নেড়ে যাই। ভালবাসার ঘাটতি মেটাতে গিয়ে মরীচিকার পেছনে ছুটে মরি। সঠিক সময়ের আগেই মিথ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। কিন্তু বাবা-মা'র ভালবাসা টা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করতে পারলে আমাদের ভালবাসার এত হাহাকার থাকতো না। প্রকৃত ভালবাসার স্বাদ লুকিয়ে থাকে মায়ের আঁচলের তলায় আর বাবার স্নেহমাখা শাসনে। আমরা কেন বাবা-মা'র ত্যাগের কথা ভুলে যাই? আমাদের বিলাসবহুল জীবন দিতে গিয়ে তারা নিজেদের অনেক প্রয়োজন নির্দ্বিধায় এড়িয়ে যান। এতে তাদের এতটুকুও আক্ষেপ বা আফসোস থাকে না। অথচ আমরা তাদের পর্যাপ্ত সময়টুকু দিতেও কত কুণ্ঠাবোধ করি!
সেদিনের পর থেকে আর কোন লিমন কে আমি আমার জীবনে জায়গা দিই নি। যদি আবারো বাবার পছন্দের টেংরা মাছের ঝোলে ঝাল বেশি দিয়ে বাবার তৃপ্তির ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলি!

#মরীচিকা

#লিখা- Nusrat Khan Ani

Mahin Al Maruf changed his profile picture
6 yrs

image

Mortuzza Mahmud Sani

Mortuzza Mahmud Sani

image

Mortuzza Mahmud Sani

image

Mortuzza Mahmud Sani

image

#tamjidahmed

image

image
Tamjid Ahmed changed his profile cover
6 yrs

#tamjidahmed

image
Tamjid Ahmed changed his profile picture
6 yrs

image