১০ মহররম পবিত্র আশুরা। এটি একটি পবিত্র ও তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত কারণে দিনটির তাৎপর্য অনেক। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে বহু ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতি জড়িত রয়েছে এ দিনের সঙ্গে। এই দিনে মহান আল্লাহ তাঁর অনেক প্রিয় বান্দার কষ্টকর অবস্থার অবসান ঘটিয়েছেন, আবার অনেকের তাওবা কবুল করেছেন এবং অনেকের কবুল করবেন। এক হাদিসে এসেছে, নবী (সা.) বলেন, যদি তুমি রমজান মাসের পরে মাসজুড়ে রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররম মাসে রোজা রাখো। কারণ সেটি আল্লাহর মাস। তাতে আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করেছেন এবং অন্য সম্প্রদায়ের তাওবা কবুল করবেন। (তিরমিজি, হাদিস : ৭৪১)
নুহ (আ.) দীর্ঘ ৯৫০ বছর মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। তাঁর সম্প্রদায় ঈমান গ্রহণ না করায় মহান আল্লাহ মহাপ্লাবন দিয়ে তাদের ধ্বংস করেন। নুহ (আ.) তাঁর অল্পসংখ্যক ঈমানদার অনুসারীকে নিয়ে নৌকায় আরোহণ করেন। ছয় মাস পর আশুরার দিনে তাঁর নৌকা জুদি পাহাড়ে অবতরণ করে। তাঁরা মুক্তি লাভ করেন। (ইবনে কাসির, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২৪)
পবিত্র কোরআনে মুসা (আ.) ও ফেরাউনের এক নির্ধারিত সময়ে উন্মুক্ত প্রান্তরে মুখোমুখি হওয়ার বিষয় বর্ণিত হয়েছে। ফেরাউন সারা দেশের জাদুকরদের জমায়েত করে। জাদুকররা অসংখ্য রশি ছেড়ে দেয়। সেগুলো সাপ হয়ে মুসা (আ.)-এর দিকে এগিয়ে যায়। মুসা (আ.) তাঁর হাতের লাঠি ছেড়ে দিলে তা বড় সাপ হয়ে তাদের সব সাপকে গ্রাস করে নেয়। আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.)-কে বিজয় দান করেন। এ দিনটিও ছিল আশুরার দিন। (তাফসিরে ইবনে কাসির, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০০)
এই দিনেই ইয়াকুব (আ.) বহু শোকতাপ করার পর হারানো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে ফিরে পান। (রুহুল মাআনি ১৩তম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭)
কারবালার ময়দানে শোকাবহ মর্মস্পর্শী ও হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতারণাও হয় ৬১ হিজরির ১০ মহররম আশুরার দিনে (৬৮০ খ্রিস্টাব্দের ১০ অক্টোবর)। মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হুসাইন (রা.) ইয়াজিদের সৈন্য পাষণ্ড সিমারের হাতে শাহাদাতবরণ করেন।
তাই ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা যায়, আশুরার তাৎপর্য পৃথিবীর শুরু থেকেই বিদ্যমান। কারবালার ঘটনা আশুরাকে তাৎপর্যপূর্ণ করেনি; বরং এটি আশুরায় ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহের তালিকায় সংযোজিত হয়েছে।
রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাবের আগে থেকেই আরবরা মহররমকে সম্মান করত। তারা এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও অন্যায়-অত্যাচার করাকে পাপ মনে করত। ইসলাম এ মাসকে সম্মান প্রদর্শন করতে এবং এ মাসের প্রতি যত্নবান হতে বলেছে। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে, তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৩৬)
সম্মানিত চারটি মাসের মধ্যে মহররম অন্যতম। হাদিসে মহররমকে আল্লাহর মাস হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, আফজালুস সিয়াম বাদা রমাদান শাহরুল্লাহিল মুহাররম। অর্থাৎ রমজানের রোজার পর সর্বাপেক্ষা উত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা। (মুসলিম, হাদিস : ২৮১২)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করার পর ইহুদিদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখেন। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা এই দিনে রোজা রাখো কেন? তারা জবাবে বলল, এই দিন পুণ্যময় দিন। আল্লাহ তাআলা এই দিনে বনি ইসরাঈলকে শত্রুর কবল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। মুসা (আ.) কৃতজ্ঞতা প্রকাশে এই দিনে রোজা রেখেছিলেন। (তাই আমরাও এ দিনে রোজা রাখি)। তখন নবী (সা.) বলেন, আমি তোমাদের চেয়ে মুসা (আ.)-এর অধিক নিকটবর্তী। অতঃপর নবী (সা.) নিজেও এ দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদের রোজা রাখতে বললেন। (বুখারি, হাদিস : ১৯০০) আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে বিগত এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গণ্য হবে। (মুসলিম, হাদিস : ২৮০৩) রাসুল (সা.) আরো বলেন, তোমরা আশুরার দিনে রোজা রাখো এবং এর পূর্বে এবং পরে অতিরিক্ত একটি রোজা রেখে ইহুদিদের ব্যতিক্রম করো। (আল-বাইহাকি আল-কুবরা, হাদিস : ৮১৮৯)
এখানে রোজা পালনের পদ্ধতির মধ্যেও অন্যদের সামঞ্জস্য হওয়াকে রাসুল (সা.) পছন্দ করেননি। বোঝা যায়, একজন মুসলমানের ইবাদত-বন্দেগি, চাল-চলন, রীতি-নীতি ও জীবন-জীবিকা সব কিছুই স্বতন্ত্র হওয়া উচিত।
আশুরার দিনে শুধু কারবালার ঘটনা কেন্দ্র করে তাজিয়া বা শোকযাত্রা, কান্নাকাটি, মাতম-মর্সিয়া, শরীরের রক্ত বের করা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড সংগত নয়। এগুলো শরিয়তসম্মতও নয়। আশুরার তাৎপর্য ও উদ্যাপন পদ্ধতি কারবালার ঘটনার আগে থেকেই স্বীকৃত। তবে কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা যুগে যুগে মুসলিম জাতিকে আত্মত্যাগের মাধ্যমে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে প্রেরণা জোগাবে, ইনশাআল্লাহ।