আমার মেয়ে নামিরাহ আজমিন। করোনায় মেয়েটা বেশি কষ্ট পেয়েছে। তখন ওর বয়স মাত্র ৩ মাস। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে নেবুলাইজ করতে হতো। কী যে কষ্ট। করোনা ভালো হয়ে গেলেও ছোট্ট শরীরটাতে অনেকটা পুড়ে গেলে যেমন হয়,সে ধরনের ফোসকাগুলো ছিল অনেকদিন। মেয়ের বয়স এখন ৭ মাস। সে সুস্থ হয়েছে। তবে মেয়েকে নেবুলাইজ করার ছবিটার দিকে এখনো তাকাতে পারি না।
কথাগুলো বলছিলেন যমুনা টেলিভিশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাহাদাত হোসেন। শুধু মেয়ের করোনা পজিটিভ ছিল তাই না, এপ্রিল মাসের শুরুতে শাহাদাত হোসেন, তাঁর স্ত্রী প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের এক্সিকিউটিভ অফিসার মৌসুমি শবনম, শাহাদাত হোসেনের শ্বশুর, শাশুড়ি এবং ৩০ বছর বয়সী বাসার সহকারী সবাই প্রায় একই সময়ে করোনা পজিটিভ হয়ে অসুস্থ হন। শাহাদাত হোসেন এবং তাঁর শ্বশুরকে হাসপাতালে থাকতে হয়। দীর্ঘ ২৮ দিন সংগ্রামের পর পরিবারের সব সদস্যের করোনা নেগেটিভ আসে।
শাহাদাত হোসেন নিজেসহ পরিবারের সদস্যদের কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছেন বলে অন্য করোনা রোগীর কষ্ট কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী করোনা রোগীকে সুস্থ করার জন্য প্লাজমা দিয়েছেন। এ পর্যন্ত শাহাদাত হোসেন নিজ উদ্যোগে প্রায় ৪০ জনের জন্য প্লাজমা সংগ্রহ করে দিয়েছেন। গল্পটা এখানেই থেমে যায়নি। যাঁরা প্লাজমা দিতে চান এবং এবং যাঁদের প্লাজমা দরকার এই দুই দলকে একসঙ্গে করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তৈরি করেন প্লাজমা ব্যাংক নামের গ্রুপ। এ গ্রুপের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১০০ জনের বেশি ব্যক্তি প্লাজমা সহায়তা পেয়েছেন। পরিচিতদের মধ্যে কারও প্লাজমা লাগলেই শাহাদাতের খোঁজ শুরু হয়।
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত
শাহাদাত বললেন,গ্রুপের মাধ্যমে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে প্লাজমা পেতে সহায়তা করি। বলা যেতে পারে, দুই দলের মধ্যে সমন্বয় করিয়ে দেওয়ার কাজটি করি। দেশ সমাচার নামের একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের সহযোগিতায় একটি ডেটাবেইস তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি, যেখানে ডোনার এবং গ্রহীতার সব তথ্য থাকে।
বেসরকারি টেলিভিশনটিতে শাহাদাত সংবাদ উপস্থাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। করোনা মোকাবিলা করে তিনি আবার কাজে ফিরেছেন।
শাহাদাত বললেন, দেশে করোনাভাইরাস বিস্তারের প্রায় শুরুর দিকেই তিনি এবং তাঁর পরিবার আক্রান্ত হন। তাই বেশ বৈরি পরিবেশে মোকাবিলা করতে হয়েছে। রাজধানীতে নিজের ফ্ল্যাটে থাকার পরও ফ্ল্যাট সমিতির অন্য সদস্যরা সহায়তা না করে উল্টো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছিলেন।
শাহাদাত বলেন,আমি আর আমার শ্বশুর হাসপাতালে ভর্তির পর পরিবারের অন্য সদস্যদের করোনা পজিটিভ হয়। এই সময়ে আত্মীয়স্বজন খাবার পাঠালে ভবনের অন্যদের অসহযোগিতার কারণে খাবার বাসায় পৌঁছাতে পারেনি। এমনকি ঈদের আগের দিন খালা শাশুড়ির পাঠানো খাবার কেউ খেতে পারেনি। আর যেহেতু আগে থেকে কোনো প্রস্তুতি ছিল না, আমি বা আমার শ্বশুরও বাড়িতে নেই, ফলে বাড়ির সদস্যদের খাবারের কষ্টও করতে হয়েছে। আমরা হাসপাতাল থেকে ফেরার পরও শ্বশুরের করোনা পজিটিভ ছিল। একেক জনকে একেক রুমে রাখতে হয়েছে। কে কার সেবা করবেন? সবারই অবস্থা কাহিল। সে গল্পগুলো খুব কষ্টের গল্প।
করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আগে শাহাদাত পেশাগত দায়িত্বপালন করেছেন। শাহাদাত বলেন, চীন থেকে সর্বশেষ কিছু যাত্রী নিয়ে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণ করে কাতার এয়ারওয়েজের একটি বিমান। ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যাই সেখানে। ২৫ মার্চ অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলেই কভার করি খালেদা জিয়ার মুক্তির অ্যাসাইনমেন্ট। পরেরদিন সকালে নির্ধারিত সংবাদ উপস্থাপনা করতে গিয়ে কাশি শুরু হয়। আমি আগে থেকেই অ্যাজমার রোগী, ইনহেলার ব্যাগেই থাকে। ইনহেলার নিয়ে বুলেটিন শেষ করি। পরে অফিস বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তারপর তো শুরু হয় করোনার তাণ্ডব।
হাসপাতালে যাওয়ার প্রসঙ্গে শাহাদাত ফেসবুকে লিখেছেন, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে ভেতরটা কেমন যেন দুমড়ে-মুচড়ে উঠল। একবার মনে হলো এটা কি আমার শেষবারের মতো যাত্রা?
করোনার সময় পদে পদে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন উল্লেখ করে শাহাদাত বলেন,হাসপাতাল থেকে নিজের ফ্ল্যাটে ফিরতেও বাধার সম্মুখীন হয়েছি। কেন আমরা বাসায় ফিরছি তাই নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এটা শুধু আমার গল্প নয়, প্রতিটি করোনা রোগী ও তার পরিবারের গল্প। হাসপাতালে একজন কান্না করতে করতে জানিয়েছিলেন, করোনার ভয়ে দেড় মাস বয়সী সন্তানসহ তাঁর স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। প্লাজমা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হচ্ছে। প্লাজমা প্রয়োজন এ ধরনের পরিবারের সঙ্গেও অনেকে প্রতারণা করছেন। সব মিলে ভয়াবহ মন খারাপ হয়।
তবে এত মন খারাপের গল্পের মধ্যেও এখন যখন প্লাজমা সংগ্রহ করে কোনো পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারেন তখন শাহাদাতের নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়। করোনার সময় মানুষের অনেক খারাপ চেহারার ভিড়ে অফিসের সহকর্মী, টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া চিকিৎসকসহ যাঁরা যাঁরা পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শাহাদাত।
শুরুর দিকে করোনা মোকাবিলার কৌশল কারও জানা ছিল না, আস্তে আস্তে কৌশলগুলো আয়ত্তে আসছে, তাই দেশ থেকে একদিন করোনা নির্মূল হবে বলেও বিশ্বাস শাহাদাতের।