বিচারব্যবস্থায় মহানবী (সা.)-এর নিরপেক্ষতা

Comments · 1101 Views

ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে বিচারিক নিরপেক্ষতার ভূমিকা অপরিসীম। তাই পৃথিবীতে ন্যায়পরায়ণতার অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন মহানবী (সা.)। তাঁর সময়ের বিচারব্যবস্থা এতটাই ইনসাফপূর্ণ ছিল যে তাতে মুসলিম-অমুসলিম সবাই সমান আস্থা রাখত। কারণ তিনি ছিলেন একজন নিরপেক্ষ বিচারক।

মহানবী (সা.)-এর জীবনাচারের অনেক ঘটনাই এ কথার সাক্ষী দেয়।

একবার আনসার গোত্রের বনি উবাইরাকের এক মুসলিম ব্যক্তি কতাদাহ ইবনে নোমান নামক এক প্রতিবেশীর একটি বর্ম চুরি করল। তার নাম ছিল ত্বমা ইবনে উবাইরাক। আর এ বর্মটি আটা ভর্তি একটি খাপে ঢোকানো ছিল। কাজেই চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় খাপের ছিদ্র দিয়ে আটা ছড়াতে ছড়াতে নিজ ঘর পর্যন্ত গেল। এরপর সেটি জায়েদ ইবনে সামিন নামক এক ইহুদির কাছে লুকিয়ে রাখল। অতঃপর ত্বমা ইবনে উবাইরাকের কাছে বর্মের অনুসন্ধান চাইলে সে বর্ম নেয়নি মর্মে আল্লাহর নামে শপথ করল। তখন বর্মের মালিক বলল, আমি তার ঘরে আটার চিহ্ন দেখেছি। এর পরও যেহেতু সে শপথ করেছে তাই তাকে ছেড়ে দেওয়া হলো এবং সবাই মিলে আটার চিহ্ন অনুসরণ করে ওই ইহুদির ঘর পর্যন্ত পৌঁছাল এবং সেখানে বর্মটি পেয়ে গেল। তখন চাপের মুখে ইহুদি স্বীকার করল যে ত্বমা ইবনে উবাইরাক আমাকে এটি দিয়েছে। পরিস্থিতি খারাপ দেখে ত্বমা ইবনে উবাইরাকের এলাকাবাসী বনু জুফারের লোকেরা রাসুল (সা.)-এর কাছে এসে তাদের সঙ্গীর স্বপক্ষে অবস্থান নেওয়ার অনুরোধ জানালে (এবং তাদের সঙ্গী নির্দোষ দাবি করলে) তিনি যে ইহুদির ঘরে বর্ম পাওয়া গিয়েছে তাকে শাস্তি দেওয়ার মনস্থ করেন। তখন সুরা নিসার ১০৫ নং আয়াত নাজিল হয়, আমরা তো আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাজিল করেছি, যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন।

আটার নিদর্শন ও ঘরে বর্ম পাওয়ার কারণে রাসুল (সা.)-এর ধারণা ছিল যে ইহুদি লোকটিই চোর। কিন্তু তাঁর ধারণার বিপরীতে ওহি নাজিল হলে তিনি তা লুকিয়ে রাখেননি; বরং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করলেন যে ইহুদি নিরপরাধ, আর চোর হচ্ছে মুসলিম ব্যক্তিটি...! (মুসতাদরাকে হাকিম : ৪/৩৮৫-৩৮৮) [ওই লোকটি মূলত মুনাফিক ছিল। মুসলিম পরিচয়ধারী ওই ব্যক্তির মুনাফিক হওয়ার বিশদ বিবরণ তিরমিজির বর্ণনায় উঠে এসেছে, তিরমিজি, হাদিস : ৩০৩৬]

দেখুন, সাফাইয়ের ঘোষণা এসেছে ইহুদি ব্যক্তির পক্ষে। যে ইহুদি জাতি ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যারোপ করা, ষড়যন্ত্র করা, মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো এবং তাঁর অনুসারীদের মাঝে ফাটল সৃষ্টিতে সদা তৎপর থাকে। এত কিছুর পরও এসব নেতিবাচক দিক ও প্রেক্ষাপটগুলোও একজন ইহুদিকে অযথা দোষারোপ করার অনুমতি দেয়নি। আরো দেখুন, অভিযোগটি দাঁড়িয়েছে এক আনসারি মুসলিম ব্যক্তির বিপক্ষে। আপনি জানেন কি, কারা এ আনসার? তারা ওই সব লোক যারা রাসুল (সা.)-কে তাঁর দুরবস্থার সময় সাহায্য করেছে, আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছে, যারা ইসলামী রাষ্ট্রের কর্ণধার। যাদের কাঁধের ওপর দিয়েই মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত রচিত হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুও তাদের একজন চোরের পক্ষাবলম্বন ও সাফাই ঘোষণার অনুমোদন দেয়নি; যদিও প্রতিপক্ষের লোকটি একজন ইহুদি। উপরন্তু এ ঘটনাটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনের জন্য ইহুদিদের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দেবে। এত কিছুর পরও মহানবী (সা.) সত্যের সত্যায়ন ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প ভাবেননি।

প্রিয় পাঠক! আপনি যদি এ ব্যাপারে আরো সুস্পষ্ট ধারণা পেতে চান এবং এ বাস্তবতাকে আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে চান তাহলে সামনের ঘটনাটির প্রতি লক্ষ করুন, যা ঘটেছিল এক ইহুদি ও মহানবী (সা.)-এর অত্যন্ত স্নেহভাজন সাহাবি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.)-এর মধ্যে।

জাবির (রা.) বলেন, মদিনায় এক ইহুদি ছিল। সে আমাকে আমার খেজুর পাড়ার মেয়াদ পর্যন্ত ঋণ দিত। একবার আমি ঋণ পরিশোধে এক বছর বিলম্ব করলাম। এরপর খেজুর পাড়ার মৌসুমে ইহুদি আমার কাছে এলো, আমি তখনো খেজুর পাড়তে পারিনি। আমি তার কাছে আগামী বছর পর্যন্ত অবকাশ চাইলে সে অস্বীকার করল। এ খবর মহানবী (সা.)-কে জানানো হলো। তিনি আমার বাগানে এলেন। ইহুদির সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা বললেন। সে বলল, হে আবুল কাসিম! আমি তাকে আর অবকাশ দেব না। এভাবে রাসুল (সা.) কয়েকবার বিভিন্ন উপায়ে ইহুদিকে সুপারিশ করার পরও সে তা গ্রহণ করল না। এরপর ভিন্ন উপায়ে ইহুদির ঋণ পরিশোধ করা হলো। (বুখারি, হাদিস : ৫১২৮, সংক্ষেপিত)

এ ঘটনা ঘটেছে গোটা মদিনার একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিত্ব নবী (সা.)-এর একান্ত স্নেহভাজন এক সাহাবি এবং মদিনারই আরেক সাধারণ জিম্মি ইহুদি নাগরিকের সঙ্গে। ঋণী ব্যক্তি শুধু সময় চাচ্ছেন। টালবাহানাও করছেন না, আবার অস্বীকারও করছেন না। উপরন্তু স্বয়ং মদিনার অধিপতি সুপারিশ করলেন; কিন্তু ইহুদি তা মানল না। এত কিছুর পরও তিনি ইহুদিকে সুপারিশ গ্রহণে বাধ্য করলেন না।

এটিই প্রকৃত ইসলাম, এটিই নববি আদর্শ...!

Comments