Back To Blogs | My Blogs | Create Blogs

অবিবাহিত একজন বয়স্ক নারীর ভাবনা

ইয়া আবি, জাওয়্যিজনি আরবি ভাষায় রচিত বিখ্যাত বই। বাংলা অনুবাদ আব্বু আমাকে বিয়ে দিয়ে দিন। বইটির লেখক আবদুল মালিক আল-কাসিম। বিয়ে, পরিবার ও সুখময় দাম্পত্য জীবনের রহস্য তুলে ধরা হয়েছে এ বইয়ে। সে বই থেকে একটি কাহিনি সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত ভাষান্তর করেছেন তাজুল ইসলাম

বাবার গৃহে আমি ছিলাম খুবই আদুরে মেয়ে। আমার কোনো চাওয়াই অপূর্ণ থাকত না। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন বলে আমার স্নেহ-ভালোবাসা ও আদর-যত্নে কোনো কমতি ছিল না। সবাই আমার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখত। আমার সব আবদার পরিবারের সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিত। আমি গভীরভাবে পড়াশোনায় মনোযোগ দিলাম এবং মাধ্যমিক স্তরে উত্তীর্ণ হলাম।

একদিন মায়ের দেওয়া একটি সংবাদে প্রথমবারের মতো কাঁপুনি ধরল আমার হৃদয়ে। তিনি বলেন, অমুক তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আমি আশ্চর্য হলাম, বিরক্ত হলাম। একে একে অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করলাম। এদিকে প্রস্তাব আসার এই ধারাও অব্যাহত থাকল। আমি সর্বদা একই প্রশ্ন করতামছেলের যোগ্যতা কী? তার মধ্যে কী কী গুণ আছে? বিচিত্র সব পেশার যুবক এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেরা আমার পরিবারের কাছে সম্বন্ধ পাঠাত। একবার আবদুল্লাহ নামের অসাধারণ এক যুবক বিয়ের প্রস্তাব দিল। সে জ্ঞানে-গুণে অন্য অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিল। তবু আমি প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলাম। কারণ আমি সুন্দরী, আমি মেধাবী; আমার একটা অবস্থান আছে। পড়ালেখা শেষে যখন কর্মজীবনে পা রাখলাম, সম্বন্ধ আসার ধারা বেড়ে গেল। তবে এতে কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেল। যারা প্রস্তাব নিয়ে আসছে, তাদের বয়স খানিকটা বেশিত্রিশের আশপাশে!

সময় গড়াতে লাগল। এরই মধ্যে এমন একটি প্রস্তাব এলো, যা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। এক ব্যক্তি প্রস্তাব নিয়ে আসে যে সে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে এবং তার একটি সন্তান আছে। এমন প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে একটা ধাক্কা খেলাম। পরক্ষণেই বললাম, বেচারা বোধ হয় আমার অবস্থা জানে না, আমি কে। তার জন্য আমার একধরনের করুণা হলো।

দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়, মাস ফুরায়; এদিকে আমার বয়সও বাড়তে থাকে। কিন্তু সেদিকে আমার কোনো খেয়াল নেই। আমি আমার কাজে মগ্ন। বয়সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একদিকে আমার দৈহিক লাবণ্য ও কমনীয়তা কমতে থাকে, অন্যদিকে বাড়তে থাকে আমার কাজের চাপ ও দায়িত্বের পরিধি। আমি সবার বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে থাকি আর আবদুল্লাহর মতো এক তরুণের প্রস্তাব পাওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকি। কিন্তু আমার আশার গুড়ে বালি! খবর নিয়ে জানলাম, আবদুল্লাহ এখন চার সন্তানের বাবা আর আমি এখনো কুমারী বুড়ি। আমার বয়স এখন ৩০ ছুঁই ছুঁই। ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে জীবন! এইতো আমার বান্ধবী ফাতিমা, সে এখন চার সন্তানের মা। আরেক বান্ধবীর কোলজুড়ে চাঁদের মতো ফুটফুটে দুটি মেয়ে। আরেক বান্ধবী স্বামীকে নিয়ে কী সুখে দিন কাটাচ্ছে! অথচ তাদের আর্থিক অবস্থা নিতান্তই সাধারণ। আর আমি...!

আমি নির্ঝঞ্ঝাট আরামে দিনাতিপাত করছি। আসলে আমি আত্মপ্রবঞ্চনায় ভুগছি; নিজের সঙ্গে মিথ্যা বলছি। সত্যি কি আমি সুখে আছি? জনতার ভিড়ে এক অদ্ভুত নির্জনতা আমাকে জেঁকে ধরেছে। এদিকে আমার চারপাশে বিচিত্র সব ফিতনা ও পরীক্ষা এসে ভিড় জমাচ্ছে, আমাকে গ্রাস করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা আমাকে অশ্লীল ও নির্লজ্জ কাজ থেকে হিফাজত করেছেন। এরই মধ্যে আমার তীক্ষ মেধা ও কঠিন অধ্যবসায় কর্মক্ষেত্রে আমাকে পৌঁছে দিয়েছে সাফল্যের সর্বোচ্চ স্তরে। কিন্তু এই সফলতা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়।

একদিন আমি অফিস থেকে ফিরলাম। বাসায় ফিরে দেখি, মা আমার উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে আমার বালিশের ওপর রেখে দিয়েছেন। তাতে লেখা, মেয়ে আমার, অমুক তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। সে ভালো চাকরি করে, আর তার বয়সও কম। আশা করি তুমি সায় দেবে; যদিও তার অন্য এক স্ত্রী ও ছয়জন সন্তান রয়েছে। দিন কিন্তু চলে যাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করে আমাকে জানাও।

আমি চিরকুটটা গভীর মনোযোগে পড়লাম এবং রাগে ফেটে পড়লাম। আমি মাথার চুলের দিকে তাকালাম। মাঝে মাঝে সাদা হয়ে ওঠা চুলগুলো লুকাতে এরই মধ্যে আমি কলপ লাগাতে শুরু করেছি। ভাবতে ভাবতে কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। শেষ পর্যন্ত এমন একজন লোকও আমাকে প্রস্তাব দিল? আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। রেগেমেগে সেই সন্ধ্যায় আমি বাবার কাছে গেলাম। তাঁকে বললাম, কিভাবে আপনারা এমন একজন মানুষের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন, যার ছয়টা সন্তান আছে? বাবার জবাব আমার অন্তরে ধারালো ছুরির মতো বিদ্ধ হলো। তিনি বলেন, কয়েক মাসে আমাদের কাছে এমন বিবাহিতরা ছাড়া অন্য কেউ প্রস্তাব নিয়ে আসেনি। আমার ভয় হয়, কিছুদিন পর হয়তো এমন সময় আসবে, যখন প্রস্তাব আসাই বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়ে আমার, মুরব্বিরা একটা কথা বলতেন, মেয়েরা গোলাপের মতোছিঁড়তে দেরি করলে পাপড়িগুলো ক্রমে শুকিয়ে আসে। আমার মনে হয়, তুমিও সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেছ। মেয়ে, তোমার কাছে তো শত শত প্রস্তাব এসেছিল, তুমি এক এক করে সব প্রত্যাখ্যান করেছ। ও বেশি লম্বা, সে বেশি খাটো, ওর এই দোষ, অমুকের এই সমস্যা। আর এখন? এমন সময় এসেছে, তুমি আর কাউকেই পাচ্ছ না!

অতীত স্মৃতিগুলো আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আব্বু, আপনি যদি তখন জীবনের এই বাস্তবতা বোঝাতেন, আমি এখন আপনাকে তিরস্কার করতাম না। হায়, আপনি যদি এর জন্য আমাকে প্রহার করতেন, আমার এই পরিণতি হতো না। এসব বলতে বলতে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম।

এখন আর কোনো যুবকই আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসে না। না লম্বা, না খাটো; না ধনী, না গরিবকেউ না।


Shakib Khan

106 Blog posts

Comments