মনে হচ্ছিল যে এখন মৃত্যুদণ্ড হবে

Comments · 1602 Views

সায়রা রহমানের ভাই ছিলেন ভেন্টিলেশনে। আর তিনি নিজে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিউ)। করোনাভাইরাস এই ভাইবোনকে মৃত্যুযন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছিল। দুজনেই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তবে খুব কাছ থেকে দেখেছেন মানুষের অসহায়ত্ব।

বারডেমে জেনারেল হাসপাতালের দন্তচিকিৎসক সায়রা রহমানের (৫০) ভাই আসিফুর রহমানের (৪২) রোজার ঈদের দুদিন আগে করোনা ধরা পড়ে। বারডেমে ভর্তি করান। সায়রা জানান, ভর্তির পর থেকে জ্বর ও কাশি বাড়তে থাকে ভাইয়ের। এরপর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। বারডেমে আইসিইউ খালি না পাওয়ায় গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিয়ে আইসিইউতে ভর্তি করান।

ভাইয়ের এ অবস্থার মধ্যেই সায়রা রহমানও শারীরিকভাবে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করতে থাকেন। তিনি নিজেও তখন করোনার জন্য পরীক্ষা করান। পরিবারের অন্যদের নিরাপদে রাখতেই তিনি শুধু ভাইয়ের দেখভালের জন্য হাসপাতালে থেকে যান। সায়রা বলেন, আমার ভাই অটিস্টিক। ও আমাদের সঙ্গে কথা বললেও অন্যদের সঙ্গে কথা সহজে বলে না। আমি একাই সামলেছি। বাকিদের আসতে নিষেধ করেছি। এক পরিবারের তো সবাই মিলে আক্রান্ত হওয়া যাবে না। আমার ছেলেমেয়ে স্বামীর কাছে ছিল।

আইসিউতে থেকেই সায়রার ভাই আসিফুর রহমানের শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। সায়রা বলেন, ওর অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাচ্ছিল। তখন চিকিৎসক বললেন যে ভেন্টিলেশনে নিতে হবে। তখন বুঝতে পারছিলাম না কী করব। আরেক ভাইকে জানালাম। চিকিৎসক বললেন, সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। মনে হচ্ছিল যে এখন মৃত্যুদণ্ড হবে। আসলে এরকম অবস্থায় তো কখনো পড়িনি। আর ভেন্টিলেশন শুনলেই আত্মা কেঁপে উঠে। এখান থেকে মানুষ ফিরে আসে খুব কম।

ভাইকে ভেন্টিলেশনে রাখার মধ্যেই সায়রা রহমান জানতে পারেন তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন। একই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে থাকেন। তিনি বলেন, দুদিন পর থেকে আমার শরীর খারাপ হওয়া শুরু হলো। খুব দুর্বল লাগত। এর সঙ্গে শুরু হলো প্রচণ্ড কাশি। কথা বলতেও কষ্ট হতো। পাঁচ বা ছয় দিনের মাথায় শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। দুই দিন অক্সিজেন দিয়ে রেখেছিল। কিন্তু অবস্থার উন্নতির হচ্ছিল না। তখন আমায় মৃত্যুভয় পেয়ে বসল। একপর্যায়ে আমাকে পরে আইসিইউতে নেওয়া হলো।

আইসিইউর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে সায়রা রহমান বলেন, আইসিউতে গিয়ে দেখলাম যে একটা বেড খালি না হতেই আরেকজন রোগী চলে আসত। একেকজনের মানসিক অবস্থা বলার মতো ছিল না। রোগীদের অনেকেই একা একা কথা বলতে থাকতেন, চেঁচামেচি করতেন। প্রতিদিনই দেখতাম কেউ না কেউ মারা যেতেন।

মৃত্যুভয় পেয়ে বসেছিল সায়রা রহমানের। ছুটে যেতে যাইতেন পরিবারের কাছে। তিনি বলেন, ওখানে দেখতাম যে একটা বেডে চারদিকে পর্দা টানিয়ে দিত, মারকাজুলের লোকজন আসত। চুপচাপ লাশ নিয়ে চলে যেত। এই যে একজন মানুষ মারা গেলেন, কারও কোনো শব্দ নেই। মানে পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষ এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মৃত্যু এতটা নিঃশব্দ হতে পারে ওখানে না থাকলে বুঝতে পারতাম না। আমার শুধু মনে হতো, দরজা দিয়ে বের হয়ে পরিবারের কাছে চলে যাই।

সায়রার ভাই আসিফুরের অবস্থার উন্নতি হওয়ায় পাঁচ দিনের মাথায় ভেন্টিলেশন থেকে ছাড়া পান। আর সায়রা রহমান সাত দিন পরে আইসিউ থেকে বের হন। গত ১৭ জুন সায়রা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরেন আর ভাই ২২ জুন। তিনি বলেন, ভাইয়ের আগে থেকেই কিছু সমস্যা রয়েছে। বাসায় এলেও ওর অন্যান্য চিকিৎসা চলছে।

হাসপাতাল থেকে ফিরলেও শারীরিক আর মানসিক ধকল গেছে সায়রা রহমানের ওপর। এখনো ক্লান্ত অনুভব করেন। তিনি বলেন, স্বামী বলেছেন, তোমাকে আল্লাহর নামে ছেড়ে দিলাম। ওরা সবাই খুব মানসিক কষ্ট পেয়েছে। তবে পরিবারের সমর্থন এবং মানুষের অনেক দোয়া পেয়েছি এ সময়টায়।

Comments