দেশে এখন একজন করোনা সংক্রমিত রোগীর মাধ্যমে নতুন একজন সংক্রমিত হচ্ছেন। সংক্রমণের এই চিত্র গতকাল শনিবারের। বিশেষজ্ঞরা এই পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রবণতা বলছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বুলেটিনে নমুনা পরীক্ষা ও রোগী শনাক্ত হওয়ার যে তথ্যউপাত্ত দেওয়া হচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সংক্রমণ হার একের নিচে। তবে এখন নমুনা পরীক্ষা কম হচ্ছে। কম পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে সংক্রমণ হার নির্ণয় যথাযথ হয় না। বিশেষজ্ঞরা দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার কথা বলেছিলেন। গতকাল ১১ হাজার ১৯৩টি নমুনা পরীক্ষার ফল জানানো হয়েছে। পরামর্শের চেয়ে তা ৪৪ শতাংশ কম।
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এপ্রিল মাস থেকে সহায়তা করে আসছেন অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও ডেটা বিশ্লেষকদের একটি দলের সদস্যরা। এই দলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাফিউন শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি হয়তো স্থিতাবস্থায় আছে। সংক্রমণ হার একের নিচে; এটা বলার মতো যথেষ্ট তথ্য, উপাত্ত, পরিসংখ্যান নেই। আরও বেশি পরীক্ষা হওয়া দরকার।
Lifebuoy Soap
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র আয়শা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণ কমেছে, এটা বলার সময় হয়তো আসেনি। সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
অর্জন হাতছাড়া
জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত করোনা পরীক্ষা হতো শুধু সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ল্যাবরেটরিতে। ৪ মে থেকে নতুন ল্যাবরেটরি পরীক্ষার কাজে যুক্ত হতে শুরু করে। ২৬ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৮ হাজার ৪৯৮টি নমুনা পরীক্ষার তথ্য দিয়েছিল। বলা হয়, ৬৬টি ল্যাবরেটরিতে নমুনাগুলো পরীক্ষা হয়েছে। এটাই ছিল এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক নমুনা পরীক্ষা। তারপর থেকে পরীক্ষা কমতে থাকে। অথচ ল্যাবরেটরি এখন ৭৭টি।
দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার চার মাস পরে এসে দেখা যাচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে অর্জন ধরে রাখতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরীক্ষা কমে যাওয়া তার উদাহরণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণপূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মহামারি মোকাবিলার সঠিক কৌশলগত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সরকারের পুরোপুরি ছিল না। তাই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে দেখা গেছে। আবার যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তিনি পরীক্ষার ফি নির্ধারণের বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন।
একাধিক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেছেন, ধনীরা ১০ হাজার টাকা ফি দিয়েও পরীক্ষা করাবে। যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের একটি অংশ ২০০ টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাচ্ছে না। পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসার এটি একটি প্রধান কারণ।
ল্যাবরেটরি বাড়লেও পরীক্ষা বাড়ছে না
কর্তৃপক্ষ সাফল্য ধরে রাখতে পারছে না
সময় এখনো শেষ হয়নি
বছরের শুরুতে নতুন এক ভাইরাসের সংক্রমণের কথা বিশ্ববাসীর সঙ্গে জানতে পারে বাংলাদেশের মানুষ। জানুয়ারি থেকেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রস্তুতির কথা বলতে থাকে। ১ ফেব্রুয়ারি চীন থেকে ফেরত আসা ৩১২ জন বাংলাদেশিকে আশকোনা হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করার মধ্য দিয়ে সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বাস্তব কাজে হাত দেয় বাংলাদেশ। শুরুর কাজটি ঠিকমতো হয়নি। অব্যবস্থাপনার কারণে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল চীনফেরত মানুষের মধ্যে। অব্যবস্থাপনার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতা।
চার মাস পর সেই সমন্বয়হীনতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি নাগরিকদের ইতালির মাটিতে নামতে না দেওয়ার ঘটনায়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষার মিথ্যা তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। এর জোরালো ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে না। মানুষ মনে করছে, সমন্বয়হীনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিয়ম ও দুর্নীতি।
মৌলিক কাজে কমতি
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে দেখা পাওয়া নতুন ভাইরাসটি সম্পর্কে অণুজীববিজ্ঞানী, গবেষক, জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসকদের ধারণা ছিল না। তাই একে প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের বৈশ্বিক চেষ্টা শুরু থেকেই ছিল। প্রতিটি দেশ নিজের মতো করে কাজগুলো করার চেষ্টা করেছে। তথ্য, বিশ্লেষণ, নির্দেশনা, পরামর্শ দিয়ে বিশ্বের প্রতিটি দেশকে সহায়তা করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিছু দেশ শুনেছে, কিছু দেশ আংশিক শুনেছে, অনেকে অগ্রাহ্য করেছে। যারা শুনেছে তারা তুলনামূলকভাবে স্বস্তিতে আছে, কিছু দেশ স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে।
ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মৌলিক কিছু কাজ জোরালোভাবে করতে বলেছিল। এর শুরুতে ছিল রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা। সন্দেহভাজন চিহ্নিত করে তার পরীক্ষা করতে হবে। পরীক্ষায় শনাক্ত হলে তার চিকিৎসা করতে হবে। খুঁজে দেখতে হবে বা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে দেখতে হবে ওই মানুষের সংস্পর্শে কত মানুষ এসেছিল। যারা সংস্পর্শে এসেছিল তাদের নজরদারিতে রাখতে হবে। নজরদারিতে থাকা মানুষদের কারও জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথার মতো করোনার উপসর্গ দেখা দিলে তার পরীক্ষা করতে হবে।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুজাহেরুল হক বলেন, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজকে অবহেলা করে চলেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ করত আইইডিসিআর। এপ্রিলের শেষ দিকে সংক্রমণ যখন ব্যাপক আকার ধারণ করতে শুরু করে, তখন কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজটি বন্ধ করে দেয় আইইডিসিআর।
একার কাজ নয়
মহামারি মোকাবিলার একটি দিক হচ্ছে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। এরপরে আসে চিকিৎসার বিষয়টি। কিন্তু মহামারির প্রভাব আছে মানুষের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চলাচলে, ব্যবসাবাণিজ্যে, অর্থনীতিতে। গভীর প্রভাব আছে শিক্ষায়। বিপর্যস্ত প্রায় সমাজের প্রতিটি অংশ।
এই বিপর্যয়ের আশঙ্কা থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, মহামারি মোকাবিলা স্বাস্থ্যের একার কাজ নয়। গোটা সরকারকে এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় থাকলে ইতালি থেকে বাংলাদেশিদের ফেরত আনার ঘটনাটি ঘটত না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্বলতার কারণে ভুয়া সনদের বিষয়ে দেশের মানুষ আগেই বিপদ অনুমান করতে পেরেছিল। করোনা থেকে সুস্থ হয়ে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য মানুষকে পরীক্ষা সনদের জন্য ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। মানুষ জাল সনদের শিকার হয়েছে। জাল সনদ বিক্রেতাদের মুগদা হাসপাতালের সামনে থেকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। কিন্তু মানুষ কী করে সহজে এই সনদ পেতে পারে, তার ব্যবস্থা করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সময় শেষ হয় না
সরকারের নানা পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাকখনো বলেছেন, আমরা করোনার চেয়ে শক্তিশালী; কখনো বলেছেন, করোনা মোকাবিলায় আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে; কখনো বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে আমাদের মৃত্যুহার কম। এসব কথা কিছু মানুষকে অসহায়, কিছু মানুষকে বেপরোয়া করে তুলেছে।
এখন অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। রাস্তাঘাটে, দোকানে, বিপণিবিতানে অনেকে মাস্ক ছাড়াই ঘোরাঘুরি করছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার, স্বাস্থ্যবিধি মানার বা নিয়মিত সাবানপানি দিয়ে হাত ধোয়ায় অভ্যস্ত হওয়ার যে আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সাধারণ মানুষ সেখান থেকে সরে আসছে। সাধারণ মানুষকে ক্রমাগতভাবে এই বিষয়গুলোতে যুক্ত রাখার দায়িত্ব থেকে অনেকটাই সরে এসেছে সরকার।
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে লকডাউনই (অবরুদ্ধ) একমাত্র সমাধানএমন একটি বার্তা দিয়ে গত মাসে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। সব হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়ে শেষ দিনের পরীক্ষায় ৬১ শতাংশ নমুনাদাতার করোনা শনাক্ত হয়। এটা ছিল অস্বাভাবিক। এর ব্যাখ্যা পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দা বা দেশবাসী পায়নি। লকডাউন চলছে এখন ওয়ারীতে।
ছোট ছোট এলাকা ধরে বৃহত্তর পরিসরে লকডাউনের প্রস্তুতি আছে বলে এক মাসের বেশি শোনা যাচ্ছে। সূত্র বলছে, ১৩ জনের একটি বিশেষজ্ঞ দল মানসম্মত কার্যপ্রণালিবিধি (এসওপি) তৈরির কাজ করছে। সপ্তহে অন্তত তিন দিন রাত নয়টায় এই দল সভা করে। তাদের চূড়ান্ত দলিলের জন্য বসে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়।
সবকিছুর পর মানুষ চূড়ান্তভাবে আশা করে তাকিয়ে আছে ওষুধ বা টিকার দিকে। টিকা হয়তো আসবে। কিন্তু তার জন্যও প্রস্তুতি দরকার। কাদের কাছ থেকে আমরা টিকা পাব, কত টিকা পাব, টিকাদান ব্যবস্থাপনা কী হবে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কারা আগে টিকা পাবে, যাদের দরকার অথচ পাবে না তাদের কী হবেএই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া দরকার, প্রস্তুতি দরকার। যে দেশ আগে প্রস্তুতি নেয়, তারা এগিয়ে থাকে। যার প্রস্তুতি ভালো, সে আগে নতুন স্বাভাবিক জীবন শুরু করবে।