Back To Blogs | My Blogs | Create Blogs

আদালতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং ভার্চ্যুয়াল কোর্ট

জাতীয় সংসদে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার বিল-২০২০ পাস হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির মতো যেকোনো দুর্যোগকালে ভিডিও কনফারেন্সসহ অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যমে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার বিধান রেখে জাতীয় সংসদে ৮ জুলাই বিল পাস হয়। বাংলাদেশের বিচারিক পদ্ধতির ইতিহাসে এটি বিলম্বিত হলেও নতুন ঘটনা। সারা পৃথিবীতে তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিন ধরেই বিচারিক কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার আইনসিদ্ধ করার তাগিদ ছিল। একই সঙ্গে দেশের বিদ্যমান বিচারপদ্ধতি এবং তথ্যপ্রযুক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য আনার জন্য দেশে প্রচলিত ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনেও প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার দাবিও দীর্ঘদিনের। অবশেষে কোভিড-১৯ মহামারি অনেকটা শাপে বর হয়েই এল। অন্তত আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের বেলায়। করোনার চাপেই আদালতে এখন তথ্যপ্রযুক্তির আসন পাকাপোক্ত হলো।

যদিও অতি সম্প্রতি পাস হওয়া এ বিলে বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রয়োজনের তাগিদে এই আইন প্রয়োগ করা যাবে। সে ক্ষেত্রে কোনো মহামারি হলে, জরুরি প্রয়োজন দেখা দিলে বা নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠলে উচ্চ আদালত আইনের ওই বিধান প্রয়োগ করবেন। বিলের বিধান অনুযায়ী প্রয়োজনের তাগিদে সীমিত পরিসরে ভার্চ্যুয়াল আদালত পরিচালনা করা যাবে। এর অধীনে মামলার বিচার, বিচারিক অনুসন্ধান, দরখাস্ত বা আপিল শুনানি, সাক্ষ্যগ্রহণ বা যুক্তিতর্ক গ্রহণ এবং আদেশ প্রদান করা যাবে।

সংগত কারণেই এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়াও অন্য কোনো সময়ে অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ে প্রয়োজনের তাগিদে আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি কী মাত্রায় ব্যবহার হতে পারে? অথবা আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সাক্ষ্যগ্রহণ কিংবা আবেদনকারীর ভার্চ্যুয়াল উপস্থিতি বৈধতা পাবে কি না? প্রশ্ন উঠতে পারে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার যেভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমনের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, সেভাবে মহামারি ছাড়াও অন্য কোনো নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারের দ্বারা দেশের নাগরিকদের বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে (Access to Justice) সীমিত করে দেওয়া হবে কি না। নাগরিকেরা অবশ্যই জানতে চাইবেন, জাতীয় সংসদে পাস হওয়া এ বিলের অপব্যবহার ঠেকাতে কী কী রক্ষাকবচ রাখা হয়েছে? অবশ্য এটুকু বিবেচনাবোধ সবারই আছে যে রাতারাতি একটি বিধান শতভাগ নির্ভুল হয়ে ওঠে না। চর্চার মধ্য দিয়েই সেটি যথার্থতা লাভ করে। তবে সেই যথার্থতা অর্জনের জন্য সম্ভাব্য ভুলগুলো সম্পর্কে আগে থেকেই সাবধান থাকা উচিত।

কোভিড-১৯ অতিমারির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে বিচারকাজ এখন ভার্চ্যুয়াল কোর্ট, অর্থাৎ ইন্টারনেটভিত্তিক আদালতের মাধ্যমে চলমান রয়েছে। প্রায় দুই মাসের কাছাকাছি সময় ধরে সারা দেশে নয়া পদ্ধতির এ বিচারিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহলে কথা উঠেছিল, এই ভার্চ্যুয়াল কোর্টই চালু থাকবে, নাকি স্বাভাবিক আদালত চালু করা হবে? যদিও ৮ জুলাই জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী বলেছেন, আগামী সপ্তাহ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে নিয়মিত আদালত চালু হয়ে যাবে। আইনমন্ত্রীর এ ঘোষণায়ও আইনজীবীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আইনজীবীদের মধ্যে প্রশ্ন আছে, করোনাকালে জেলা আদালত প্রাঙ্গণে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করার জন্য সরকার কী পরিমাণ আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করেছেন? একই সঙ্গে এর জন্য কী ধরনের প্রশাসনিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে? অনেকেই মনে করেন, সীমিত আকার কথাটির মধ্যে বেশ অস্পষ্টতা সৃষ্টির সুযোগ আছে। সীমিত আকারের সুবিধা কি শুধু সরকারদলীয় প্রভাবশালীরা পাবেন, নাকি এ ক্ষেত্রে জবাবদিহি থাকবে? এসব বিষয়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন না করে অগ্রসর হওয়ার পরিণাম আত্মঘাতী হবে।

এ কথা সবারই জানা যে করোনাকালে সংক্রমণ এড়াতে যখনই অফিস-আদালত, কলকারখানা বন্ধ রাখার কথা এসেছে, তখনই জীবন আগে নাকি জীবিকা আগেএ রকম প্রশ্ন সামনে এসেছে, যার সুরাহা বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুবই কঠিন। সুপ্রিম কোর্টের একজন নিয়মিত আইনজীবী হিসেবে এ রকম বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হামেশাই আমাকে হতে হয়; প্রধানত সহকর্মী বিজ্ঞ আইনজীবীদের কাছ থেকে এবং এরপর বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে। এ রকম একটি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে বিভিন্ন জেলা আদালতে সাধারণ আইনজীবীদের ব্যানারে আদালত খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। কারণ, নিয়মিত রোজগার না থাকায় সাধারণ আইনজীবীদের জীবন আজ বিপর্যস্ত।

অন্যদিকে, পত্রিকায় খবর এসেছে, সারা দেশে বিভিন্ন আদালতের ৪৪ বিচারক ও ১৬৭ কর্মচারী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। বিভিন্ন জেলা বারে অনেক আইনজীবী আক্রান্ত হয়েছেন। তা ছাড়া কমিউনিটি পর্যায়েও সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের দুই দফা ফুল কোর্ট সভা প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে উল্লিখিত বিষয়সমূহ এবং করণীয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ৮ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, করোনা পরিস্থিতি এখন খারাপ মাত্রায় থাকার কারণে এবং আদালতে বিচারপ্রার্থীদের ভিড় সংক্রমণ বাড়াবেএ বিবেচনায় ভার্চ্যুয়াল কোর্ট পদ্ধতিই চালু থাকবে। একই সঙ্গে আরও বেশি আইনগত প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য ভার্চ্যুয়াল ব্যবস্থায় দ্বৈত বেঞ্চও চালু হবে। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতে নতুন করে ভাবার এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে।

আমাদের জানা দরকার, করোনা পরিস্থিতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সরকারের নির্বাহী ঘোষিত পদ্ধতিতে দেশের আদালতগুলো চললে যদি কোনো বিচারক বা বিজ্ঞ আইনজীবী আক্রান্ত হন, তাঁদের জন্য সরকার তাঁদের চিকিৎসার পুরো দায়ভার নেবে কি না? কিংবা সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট সভার সিদ্ধান্তই সরকার অনুসরণ করবে।

এ রকম একটি অতি জরুরি বিষয়ের ফয়সালা শুধু আবেগ, দলীয় রাজনীতি কিংবা অন্য কোনো সংকীর্ণ বিবেচনা থেকে করা সঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। কারণ, আমি লক্ষ করেছি, এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন অনেকেই ভার্চ্যুয়াল কোর্ট সম্পর্কে বেশ কিছু দায়িত্বহীন মন্তব্য বিভিন্ন পর্যায়ে করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, জনগণের আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ পাওয়ার মতোই এক গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার, যা কিনা আন্তর্জাতিক আইনেও স্বীকৃত। এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারও বটে। ফলে কোভিড-১৯ অতিমারির এ বৈশ্বিক দুর্যোগকালে পৃথিবীর প্রায় সব দেশের আদালতই নাগরিকের এ অধিকারকে স্থগিত রাখেননি; বরং ভার্চ্যুয়াল কোর্টের মতো বিকল্প ব্যবস্থায়ও নাগরিকের বিচারপ্রাপ্তির অধিকারকে অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছেন। এ মানবাধিকারমুক্ত মানুষ থেকে শুরু করে জেলখানায় বন্দী আসামির জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য।

জেলা আদালতগুলোয় ফৌজদারি বিভাগ দিয়ে শুরু হলেও এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দেওয়ানি অধিক্ষেত্রেও ভার্চ্যুয়াল কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে কোভিড-১৯ মহামারির এই সময়ে দারুণ দক্ষতার সঙ্গেই হাইকোর্ট তাঁর ভার্চ্যুয়াল কোর্টের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। ফৌজদারি, দেওয়ানি এবং রিট অধিক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট মহাবিপদের এ সময়ের চাহিদা উল্লেখযোগ্য অংশেই পূরণ করেছেন। রাষ্ট্রের অনেক জরুরি বিভাগের মতোই বিচার বিভাগ এই বৈশ্বিক দুর্যোগের সময়ে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভার্চ্যুয়াল আদালতকে সচল রাখার জন্য বিজ্ঞ আইনজীবীরা এবং তাঁদের সহকারীরা তাঁদের কাছে আসা বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাঁদের কথা শুনেছেন। দলিল-দস্তাবেজ গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে বিচারপতিরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের কার্যক্রম দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য আদালতে উপস্থিত হয়েছেন এবং নিজেদের অফিসে সহকারীদের সঙ্গে দেখা করতে বাধ্য হয়েছেন। এ দায়িত্বশীল কাজের উপকারভোগী হয়েছেন দেশের লাখো বিচারপ্রার্থী। যদি করোনা মহামারির অজুহাতে হাইকোর্ট এবং সারা দেশের আদালতগুলো পুরোপুরি বন্ধ রাখা হতো, যদি বিকল্প হিসেবে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালু না করা হতো, তাহলে এই অর্ধলাখের কাছাকাছি মানুষ দেশের ধারণক্ষমতার অতীত কারাগারগুলোকে বিষাক্ত করে তুলত।

উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে এখন সিদ্ধান্ত নিতে ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে উচ্চ আদালতকে কী করে আরও সক্ষম করে গড়ে তোলা যায়, ই-জুডিশিয়ারির ধারণাকে কী করে আরও জনপ্রিয় এবং সুবিচারবান্ধব করে তোলা যায়, আইনশাস্ত্রের এবং প্রয়োজনীয় রেফারেন্সের ভার্চ্যুয়াল লাইব্রেরি কত তাড়াতাড়ি গড়ে তোলা যায়, সেই সঙ্গে সবচেয়ে বেশি দরকার বিজ্ঞ আইনজীবীদের মধ্যে যদি কারও তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত জড়তা বা দ্বিধা থাকে; তা ঝেড়ে ফেলা। এসব কিছুই হয়তো আলাদিনের চেরাগের মতো এক লাফে হবে না। কিন্তু দেরি না করে এখনই শুরু করতে হবে। এর অনেক কিছুই উচ্চ আদালতে সহজে বাস্তবায়ন সম্ভব এবং পর্যায়ক্রমে জেলা আদালতে। করোনা পরিস্থিতির কারণে জেলা আদালতে কর্মরত আইনজীবীদের আজকের তাৎক্ষণিক দাবিও এখন উপেক্ষা করার মতো নয়। তাই তাঁদের জীবিকা বাঁচাতে কীভাবে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আদালতসমূহ দ্রুতই খুলে দেওয়া যায়, তার রূপরেখাও এখনই তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার, বার কাউন্সিল, সুপ্রিম কোর্ট বার এবং জেলা বারগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।


Rajjohin Raja  

116 Blog posts

Comments