মাঝে আর চারদিন। এরপরই দিনপঞ্জির পাতা ঘুরে সেই টেস্ট ম্যাচ! না, নতুন কোনো টেস্ট না। কথা হচ্ছে ৩৬ বছর আগের এক টেস্ট নিয়ে। যে ম্যাচে দলের প্রতি নিবেদনের চূড়ান্ত করে ছেড়েছিলেন ম্যালকম মার্শাল। ঠিকই ধরেছেন। ১৯৮৪ লিডস টেস্ট। মার্শালের সেই ভাঙা হাত...বাকিটা আর না বললেও চলে।
নষ্টালজিক ক্রিকেটপ্রেমী মাত্রই ধরে ফেলেছেন সেটি ছিল 'ব্লাকওয়াশ' সিরিজের ম্যাচ। ইংল্যান্ডের মাটিতে সেবার পাঁচ টেস্টের সিরিজে সবগুলোই জিতেছিল গ্রিনিজ, রিচার্ডস, লয়েড, মার্শালদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ১৮০ রানে জেতার পর দ্বিতীয় টেস্টে ৯ উইকেটে জিতেছিল সফরকারি দল। তৃতীয় টেস্টেও সবাই ভেবেছিল জিততে তেমন অসুবিধা হবে না ক্যারিবীয়দের। কিন্তু ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংসে ২৭০ রান তোলার পর ব্যাট করতে নেমে বিপদেই পড়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৭ উইকেটে ২০৬ রান তুলে ধুঁকছিল তারা। এখান থেকে ল্যারি গোমেজ ও মাইকেল হোল্ডিংয়ের ৮৮ রানের জুটিতে ভর করে এগিয়ে যায় ক্যারিবীয়রা। হোল্ডিং আউট হওয়ার পর জোয়েল গার্নারও বেশিক্ষণ থাকতে পারেননি। ল্যারি গোমেজ ৯৬ রানে অপরাজিত। এরপর?
একটু পেছন থেকে শুরু করা যাক। নিজেদের প্রথম ইনিংসেই সুখবর পায় ইংল্যান্ড। গালিতে ফিল্ডিং করতে গিয়ে বাঁ হাতে বুড়ো আঙুলের দুটি জায়গায় ভেঙে নেন 'ম্যাকো'খ্যাত মার্শাল। চিকিৎসক বলে দিলেন, আগামী দিন দশেকের মধ্যে ক্রিকেট মাথায় না রাখতে। অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েড কিছু বলেননি। ম্যাকোকে তিনি জানতেন।
ল্যারি গোমেজ ৯৬ রানে অপরাজিত, সেঞ্চুরি হচ্ছে না, ও প্রান্তে সঙ্গী নেই। বাঁ হাতে প্লাস্টার নিয়ে শেষ উইকেট জুটিতে মার্শাল নামলেন ব্যাটিংয়ে। 'ক্রিকেটের কণ্ঠস্বর' রিচি বেনোর গলা নিরুত্তাপ। শুধু বললেন, 'মার্শাল নামছেন হাতে প্লাস্টার নিয়ে।' সিংহ-হৃদয়কে হয়তো তিনিও জানতেন! জানত না শুধু ইংল্যান্ড।
খোঁড়ানো গ্রিনিজ কত ভয়ংকর তা আগের টেস্টেই টের পেয়েছিল ডেভিড গাওয়ারের দল। লিডসে গোমেজের সেঞ্চুরি সেদিন শুধু ইংল্যান্ড কী স্বয়ং ক্রিকেট-বিধাতা বলে যদি কিছু থেকে থাকে তিনিও ননশুধু ম্যাকোর এক হাতেই ব্যাটিংয়ে নামার চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার জন্য। গোমেজের সেঞ্চুরি হলো, এক হাতে একটি চারও পেলেন ম্যাকো। ইংল্যান্ডের 'আঙুল ভাঙা' ম্যাকো-পরিচিতির মূল অংশ তখনো বাকি। নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে একটু স্বস্তিতে ব্যাটিংয়ে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিল ইংল্যান্ড। ড্রেসিংরুমের জানালা দিয়ে ক্যারিবীয়দের শরীর গরম করায় ম্যাকোকে দেখেও তাঁর বল হাতে নেওয়ার সম্ভাবনাটা হয়তো উড়িয়ে দিয়েছিলেন গাওয়াররা। ভাঙা হাতে বোলিং করবে, যাহ্! এও সম্ভব নাকি!
ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ২৬ ওভার বল করেছিলেন ম্যাকো। দলের জন্য সর্বস্ব নয়, তারও বেশি নিংড়ে দিতে এটুকুই তো যথেষ্ট। ম্যাকো সেই ইনিংসে নিয়েছিলেন ৭ উইকেট। ভাবা যায়! এর আগে ক্যারিবীয়দের প্রথম ইনিংসে মার্শাল ব্যাট করতে নেমেছিলেন হাসতে হাসতে। যেন এতটুকু ব্যাথা নেই! প্রথম বলটা ব্যাটে লাগাতে না পারলেও পরের বলে গালি অঞ্চল দিয়ে চার। তাঁর এক ব্যাট করার অবিশ্বাস্য সেই বীরত্ব এখন ক্রিকেট ইতিহাসে গল্পগাঁথার অংশ।
মূলত মার্শালের তোপেই দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫৯ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। এতে জয়ের জন্য মাত্র ১২৮ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে ৮ উইকেটের জয় পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ল্যারি গোমেজ ম্যাচসেরা হলেও সেই টেস্ট দর্শক থেকে বিশ্লেষকদের চোখে সেরা ছিলেন মার্শাল। সে ম্যাচে তাঁর অধিনায়ক ক্লাইভ লয়েডের কথাই শুনুন, 'ভাঙা হাতে সে যে পারফরম্যান্স দেখিয়েছে তা আমি নিজের ক্যারিয়ারে এর আগে কখনো দেখিনি। বিষ্ময়কর! একটা ঘটনা মনে থাকবে সব সময়। সবাই যখন বলছিল সে খেলতে পারবে না, তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম খেলতে পারবে? তার জবাব ছিল, অধিনায়ক তুমি যদি খেলাতে চাও অবশ্যই খেলব।'