১৯৩০এর দশকের শেষে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত সংহত বিকাশের সূত্র পায়। এ বিষয়ে বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবকিছুর সূচনারও একটা পটভূমি থাকে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এক দশক বা তার কিছু আগের দুটো তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা তিরিশের দশকের সংহত বিকাশের ধারাকে সম্ভব করে তোলে। প্রথমটি হলো ১৯১৮ সালে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা সমস্যার মীমাংসা। তার আগে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা কি না, এ নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের যুক্তিপূর্ণ অসাধারণ ভাষণে তার অবসান ঘটে। ওই ভাষণে তিনি প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা বাংলা।
দ্বিতীয় ঘটনা হলো, ১৯২৩ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও অন্য মুসলমান নেতাদের সঙ্গে বেঙ্গল প্যাক্ট নামে এক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির প্রধান শর্ত ছিল বিধান পরিষদের সব প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব হবে তাদের সংখ্যানুপাতে; এবং সমতা লাভ না করা পর্যন্ত সরকারি ও অন্যান্য সংস্থার চাকরিতে মুসলমানদের নিয়োগ প্রদান চলতে থাকবে।
প্রথম ঘটনাটির ফলে বাঙালি মুসলমানের আত্মসত্তা, জাতিসত্তা ও জাতীয় জাগরণের ভিত্তি তৈরি হয়। সেই ভিত্তি বা অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন পড়ে একটি সুগঠিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ। কারণ, মধ্যবিত্তরাই সামাজিক-সাংস্কৃতিক দোলাচলের সক্রিয় অংশ।
বেঙ্গল প্যাক্ট এবং পরবর্তীকালে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ফজলুল হক সাহেব মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এর ফলে বাঙালি মুসলমান সমাজের আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রকাশের নতুন দরজা খুলে যায়। ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী হয়েও শিক্ষা দপ্তর তাঁর হাতে রাখেন। ফলে বাঙালি মুসলমানের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। গড়ে উঠতে থাকে একটি সঞ্চরণশীল নতুন সমাজ। এই সমাজ আত্মপ্রকাশ ও সামাজিক জাগরণের তাড়নায় নতুন নতুন প্রকাশমাধ্যম খোঁজে। গড়ে তোলে নানা সভাসমিতি ও সংগঠন। নব-উন্মাদনা ও উদ্ভাবনামুখরতায় পুরোনো বৃত্ত ভেঙে নতুন অভিমুখের প্রত্যাশা হয়ে উঠে দীপ্র। ফলে ১৯৩০-এর দশকটি বাঙালি মুসলমানের জন্য হয়ে ওঠে এক সৃজন-ভাবুকতার কাল।
১৯২০-এর দশকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দী সম্মিলনে তাঁদের ঐতিহাসিক উদ্যোগে সৃষ্ট বেঙ্গল প্যাক্টের মাধ্যমে যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনা ঘটে, তাকে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে নব নব ভাবব্যঞ্জনা ও আর্তিতে মূর্ত করে তোলেন বাংলার অসামান্য এক কবিবিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম। এই প্রেক্ষাপটে বাঙালি মুসলমানের ঈদোৎসবের সূচনাও সেই অসাধারণকালেই।
উৎসব সামান্যকে অসামান্য করে তুলতে পারে, ধর্মীয় বিষয়ে মূলগত সত্তাকে কেন্দ্রে রেখেও নব আঙ্গিক ও ভাবব্যঞ্জনায় সামাজিক সংহতি ও আনন্দ উপভোগের সৌন্দর্যচেতনায় প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে। ১৯৩০-এর দশকে তৎকালীন বাংলার রাজধানী শহর কলকাতায় বাঙালি মুসলমানের নবজাগর চেনায় উদ্ভাবিত ঈদ উৎসব তেমনি এক অসাধারণ সৃষ্টি। অসাধারণ সৃষ্টি বলছি এ জন্য যে পূর্ব বাংলা ও অবিভক্ত বাংলার নানা অঞ্চলে আগে যে ঈদ উদ্যাপিত হতো, ইতিহাস ঘেঁটে তার যে বিবরণ পাই, তাতে দেখি বিদেশ থেকে আসা কোনো সুফি-আউলিয়া-দরবেশ ও তাঁর হুজরাখানা, খানকা বা দরগা-চিল্লায় তাঁদের মতো করে ঈদ করতেন। আরও পরে মোগল আমলে ঈদ উদ্যাপনও ছিল আমির-ওমরাহদের বর্ণাঢ্য ঈদ শোভাযাত্রাসহ ঈদগাহে যাত্রা এবং খানাপিনা ও গরিবদুঃখীদের জন্য দান-খয়রাতের মধ্যে আবদ্ধ। এতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকায় এর সামাজিক তাৎপর্য ছিল না। ঢাকার নবাবেরা ঈদ উপলক্ষে কাসিদার আয়োজন করতেন, ছিল ঈদমিছিলের শোভাযাত্রাও, কিন্তু গোটা দেশ তো নয়ই, পুরো সমাজকেও তা সেভাবে স্পর্শ করেনি।
বিগত শতকের তিরিশের দশকের কলকাতায় ঈদ উৎসব ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক সামাজিক উৎসব। এই উৎসবের নবসৃজনে এ কে ফজলুল হক সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় নবচিন্তার লেখক, সাংবাদিক, গায়ক-শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের অবদানও ছিল অনন্য। এবং এ ক্ষেত্রে কবি নজরুলের অবদান ছিল বৈপ্লবিক। বাঙালি মুসলমান সমাজে গানবাজনা নিষিদ্ধ ছিল। এই বাস্তবতার পটভূমিতে নজরুল তৈরি করলেন ইসলামি গানঈদের প্রবল জনপ্রিয় গান। ভেঙে পড়ল বাধার প্রাচীর। তাঁর সঙ্গে এই নবযাত্রায় যোগ দিলেন কিংবদন্তিপ্রতিম গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহমদ। তখন রেকর্ড কোম্পানি বের করল নজরুলের ইসলামি গানের জনপ্রিয় সব রেকর্ড। বাঙালি মুসলমানের ঈদ উৎসব শুধু সামাজিক তাৎপর্যই লাভ করল না, হয়ে উঠল এক নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণের সর্বজনীন উৎসব।
কলকাতাকেন্দ্রিক সে উৎসবের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংযোগ যে খুব বড় আকারের ছিল, এমনটা বলা যাবে না। কারণ তখনো বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজের উপরিতলে ছিল কিছু ছোট-মাঝারি চাকুরে, উকিল আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এদের অর্থবিত্ত তেমন ছিল না। তাই ঈদে তাদের কেনাকাটায় তেমন জেল্লাও ছিল না। তবু ঈদ মৌসুমে ওয়াছেল মোল্লার দোকানের বেচাবিক্রি বেশ রমরমা হয়ে উঠত। তখন পর্যন্ত বাঙালি মুসলমান নামের আগে পুরুষেরা শ্রী এবং নারীরা শ্রীমতী লিখতেন। মুসলমান মধ্যবিত্ত পুরুষেরা পরতেন ধুতি; নামাজ পড়তেন কাছা খুলে। আর তখনকার ঈদে বাঙালি মুসলমানের পোশাক ছিল ধুতি ও শার্ট। পাঞ্জাবি তখনো জনপ্রিয় হয়নি। ফজলুল হক সাহেব অবশ্য মাঝেমধ্যে সাদা পাঞ্জাবি পরতেন। পুরুষের প্রিয় পোশাক ছিল সেনগুপ্ত ধুতি।
সে সময় পূর্ব বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে যাঁরা সামান্য একটু সম্পন্ন ছিলেন, তাঁদের বাড়িতে খেজুর গুড়ের পায়েস, খিচুড়ি, কখনোবা গরুর মাংস রান্না হতো। ঈদের নামাজ হতো ঈদখোলা বা ঈদগায়; অথবা বাঁশের বেড়া কি বড়জোর টিন দিয়ে তৈরি করা মসজিদে। সেকালে ঈদের উৎসবে পুরুষের পোশাক ছিল লুঙ্গি, ধুতি ও গেঞ্জি। কখনো কখনো শার্ট বা পাঞ্জাবি। নারীরা পড়ত তাঁতের শাড়ি। বলার বিষয় হলো, নগদ পয়সার অভাবে তখনকার ঈদে এখনকার মতো চাকচিক্য ছিল না।
ঈদের দিনে আনন্দ বলতে বিকেলে হাডুডু খেলা, ষাঁড়ের লড়াই, গরুর দৌড় বা ফুটবল খেলা, আর বর্ষাকাল হলে নৌকাবাইচএই তো। এভাবেই পালিত হতো সেকালের ঈদ।