ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্রে নরেন্দ্র মোদি ও তার হিন্দুপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ধূমকেতুর মতো উত্থানের পর থেকে ভারতীয় সিনেমার একটি বড় অংশ প্রবল ও প্রকটভাবে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এগুলোতে একদিকে হিন্দু আইকনদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা, অন্যদিকে মুসলিম শাসকদের শঠ, দায়িত্বহীন ও জড়বুদ্ধিসম্পন্ন ভিলেন হিসেবে চিত্রায়িত করা হচ্ছে।
পদ্মাবৎ, বাজিরাও মাস্তানি, উরি, কেসরি, পানিপথ, তানহাজি, থ্যাকারে ও আরো অনেক বিশাল বাজেটের মুভিগুলো পুরোপুরি ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদী এজেন্ডার সাথে খাপ খেয়ে যাচ্ছে।
এসব মুভির মুক্তির তারিখের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালে বোঝা যায়, কত পরিকল্পিতভাবে সেলুলয়েডকে অতীত ভারতের মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বীজ ছড়াতে এবং জনমতকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক আদর্শের অনুকূলে পরিচালিত করতে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০১৪ সালে বিজেপি জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হওয়ার পর হিন্দু ঐতিহাসিক রোমান্স ফিল্ম বাজিরাও মাস্তানি মুক্তি পায়। ছবিটিতে হিন্দু মারাঠাদের সাহসিকতা তুলে ধরা হয়, দাক্ষিণাত্যের নিজাম ও দিল্লির মোঘলদের বিরুদ্ধে তাদের বীরত্ব এতে স্থান পায়।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আসে পদ্মাবৎ। এতে ত্রয়োদশ শতকের মুসলিম শাসক আলাউদ্দিন খিলজিকে নৃশংস, কামার্ত পশু হিসেব প্রদর্শনের মাধ্যমে ভারতে মুসলিম নৃশংসতা উপস্থাপন করা হয়।
পরমাণু: দ্য স্টোরি অব পোখরান নামের একটি ছবির কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যায়। এটি পোখরানের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি। এটি মুক্তি পায় ২০১৮ সালে, ভারতের সাধারণ নির্বাচনের মাত্র এক বছর আগে। ১৯৯৮ সালে পোখরানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরমাণু পরীক্ষা চালানোর কাজে পরলোকগত অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকার ওপর আলোকপাত করা হয়। এতে দেখানো হয়, দেশের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে বিজেপি সরকার কখনো ভয় পায় না।
২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি আসে উরি : দ্য সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। এতে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরে ভারত সরকারের সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে নাটকীয়তা দান করা হয়। মুভিটিতে মোদি, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংকে চিত্রিত করা হয়।
১১ জানুয়ারি আসে অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাবেক মিডিয়া উপদেষ্টা সঞ্জয় বারুর লেখা বই থেকে এই মুভিটি নির্মাণ করা হয়। এতে বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস দলের সাথে দুর্নীতি, বদ্ধমূল ধারণা ও স্বজনপ্রীতি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত থাকার বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
১৮ জানুয়ারি ঠাকরে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। এতে হিন্দুপন্থী রাজনৈতিক দল শিব সেনার প্রতিষ্ঠাতা বালাসাহেব থ্যাকারের জীবনী স্থান পায়। এই মুভির একটি বড় অংশে বাবরি মসজিদ ভাঙা ও সেখানে রামমন্দির নির্মাণের যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়।
২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি আসে মনিকর্নিকা: দি কুইন অব ঝাঁসি। এটি হিন্দু মারাঠা রানি ঝাঁসির লক্ষ্মীবাইয়ের জীবনী তুলে ধরা হয়। এতে বিখ্যাত ঝাঁসি অবরোধের সময় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে হিন্দুদের লড়াই দেখানো হয়।
১২ এপ্রিল মুক্তি পায় তাসকান্ত ফাইল। এতে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর মারা যাওয়ার জন্য দায়ী কংগ্রেস আর ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন রুশ গুপ্তচর।
গত মাসে পাতাল লোক নামের একটি ক্রাইম থ্রিলার মুক্তি পায়। এতে দেখানো হয়, কেবল বিভাগীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশংসা পাওয়ার জন্যই এক পুলিশ ইন্সপেক্টর বেপরোয়াভাবে উচ্চপর্যায়ের একটি মামলা নষ্ট করতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেন। কাহিনীটি নানাভাবে ভারতীয় সমাজকে প্রতিফলিত করে।
এই সিরিজে সিরিজে কবির এম নামের একটি চরিত্র আছে। এই এম দিয়ে কী বোঝানো হয়, তা তিনি অনেক প্রশ্নের মুখেও প্রকাশ করেননি। এতে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের কঠিন অবস্থা চিত্রিত করা হয়েছে।
সিরিজে কবিরের অতীত জীবনও টানা হয়েছে। স্রেফ গরুর গোশত খাওয়ার সন্দেহে তার বাবা ও কিশোর ভাইকে হিন্দু জনতার নির্দয়ভাবে হত্যার কথা বলা হয়। তাদের হত্যার সময় কবিরের বাবাকে দেখা যায় বেপরোয়াভাবে গরুর গোশত না খাওয়ার কথা বলতে।
এই সিরিজে আরো দেখানো হয়, ভারতের কারাগারগুলো মুসলিমদের জন্য কথাটা অনিরাপদ হতে পারে। কারাগারের করিডোরে কবিরের গলায় ছুরি ধরে আরেক কয়েদি বলেন, বাস্টার্ড পাকিস্তানি।