জীবন নিয়ে চরম হতাশ হয়ে যাওয়া মানুষগুলো-ই সাধারণত মৃত্যু খুঁজে বেড়ায়।

আমার জীবনে অপ্রাপ্তির বেদনা বলতে কিছু নেই। পৃথিবীতে পা রাখার পর থেকে এই এতটুকু পথচলায় কোথাও কোন শূন্যতা অনুভব করি নি। আল্লাহর কাছে কোন দরখাস্ত পেশ করার পর নামঞ্জুর হয়েছে, এমন-ও হয় নি। অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমার দিন-রাতের অধিকাংশ সময়-ই নিজেকে সুখী মানুষ বলে মনে হয়, এবং এই মনে হওয়াটা মনে-প্রাণেই হয়। তবুও কেন জানি আমার ভাবতে ভালো লাগে, আমি বেশিদিন বেঁচে থাকবো না। মৃত্যুকামনা যে করি, তা নয়; শারী‘আহ এটাকে বৈধতা দেয় নি। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবীর মায়া সাঙ্গ হচ্ছে আমার, এমন চিন্তা মাথায় এসে যায় বলা-কওয়া ছাড়া। কেন আসে জানি না; তবে এমনটা ভাবতে আমার ভালো লাগে।

ভালো লাগার অনেকগুলো দিকের মধ্যে একটা এই যে, শৈশব থেকেই আমার ইচ্ছা, আল্লাহ যেন আমাকে বাবা-মায়ের আগেই তাঁর কাছে নিয়ে যান। কৈশোরে এসে আমার ভাবুক মন বলতো, একটু বড়ো হলে এই ইচ্ছার পাতে জঙ ধরবে। কিন্তু তারুণ্যে এসেও এই অনুভূতিতে জঙ ধরা দূরে থাক্, রঙটা বরং আরো উজ্জ্বল হয়েছে। দিন যতো যাচ্ছে, আমি এই দুটো মানুষের ভেতরে মিশে যাচ্ছি। আমার অস্তিত্বের শেষ কিরণ বিলীন হয়ে যাচ্ছে দুটো অস্তিত্বের মিলিত আবির-আভায়। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা- না লাগা, নিজের ক্যারিয়ার-পড়াশোনা; কোনটাতেই আমি নিজের কোন ইচ্ছা খুঁজে পাই না। আমার প্রিয় মানুষগুলো আমাকে এ নিয়ে বকা দেন, উপদেশ দেন, উষ্মা প্রকাশ করেন। কিন্তু আমি কী করবো? আমি নিজের ভেতর যদি নিজের ইচ্ছা খুঁজে না পাই, আমার কী করার থাকে? কিন্তু কে বুঝবে কার কথা? তাঁরা আমার উপর বিরক্ত হন, আমাকে অগোচরে অমেরুদণ্ডী প্রাণী বলে হাসাহাসি করেন।

মোটকথা, আমি ফীল করি, আমার জীবনের অভিধানে বাবা-মা আমার প্রতিশব্দ। কাজেই এই দুটো মানুষ আমাকে ছুটি দিয়ে কোথাও যাবেন, এত বড় চিন্তার জগদ্দল পাথর বহন করবার মতো শক্তি আমার নেই। আমি যে মেরুদণ্ডহীন! অতএব, সবচেয়ে নিরাপদ ও উত্তম ব্যাপার হচ্ছে, আমিই তাঁদের আগে ‘নাই’ হয়ে গেলে ভালো হয় বেশি।

আরেকটা দিক হলো, যেখানে যাকে যেভাবে পেরেছি, আমার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে পারতপক্ষে আমি তাকে ভালোবাসা দিয়েছি। কিন্তু এই ভালোবাসার রিটার্ন পাওয়া শুরু হলে আমার ভেতর ভয় কাজ করা শুরু করেছে। এছাড়াও ভালোবাসার ঋণ ঘাড়ের উপর প্রতিনিয়ত বাড়ছে তো বাড়ছেই। আমি যদি খুব তাড়াতাড়ি চলে যেতে পারি, এই ঋণের বোঝাটা হাল্কা থাকতেই দায় সারতে পারলাম।

এই ধরণের চিন্তার সাথে আরেকটা প্রাসঙ্গিক বিষয় এসে মাথায় জেঁকে বসে। ওপারের জন্যে আমার সঞ্চয় কি যথেষ্ট? আল্লাহর কাছে তাই বারবার চেয়েছি, আমাকে যেন ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি ডাক দেন, যে মুহূর্তে তিনি আমার উপর সন্তুষ্ট, যে মুহূর্তে আমি ফিরদাউসের ফুল বাগানে পাখি হবার উপযুক্ত।