দিশি তাঁতির তাঁত

Comments · 1384 Views

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোরাই ধন’ গল্পের নায়িকা সুনেত্রা। ভালোবাসে শান্তিপুরে সাদা শাড়ি, কালো পাড়ওয়ালা। বলত, ‘দিশি তাঁতির হাত, দিশি তাঁতির তাঁত, এই আমার আদরের।’ এককালে বাংলার তাঁতিদের বোনা কাপড়ের কদর ছিল দুনিয়াজোড়া। বছরের পর বছর সাধারণ স্থানীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তারা মসলিনের মতো উত্কৃষ্ট বস্ত্র বুনত। উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসকদের বৈরী নীতির কারণে সংকটে পড়েছিল তাঁতিরা। স্বাধীনতার পর সত্তর ও আশির দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে শিক্ষিত সমাজের একটা অংশ তাঁতশিল্পের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারিকা, নিপুণ, কুমুদিনী, আড়ং, চম্পক, চরকা, সেতুলী, জয়া, শুকসারি, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের মতো প্রতিষ্ঠানের জন্ম এই সময়ে।

সাহস করেছেন তাঁরা

বিদেশি কাপড় মানেই ভালো—স্বাধীনতার পর এই ধারণা বদলে এগিয়ে এসেছিলেন এ দেশেরই কিছু তরুণ। তাঁরা দেশীয় কাপড়ে ফ্যাশনেবল পোশাক তৈরির যে প্রবণতা চালু করেছিলেন, সেটা আজ নগরজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একসময় পাশ্চাত্য ফ্যাশনে অনুরক্তদের বড় অংশই এখন দেশীয় কাপড়ের পোশাক পরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। শুরুতে ঢাকাকেন্দ্রিক থাকলেও এখন দেশের প্রায় সব বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো। ফলে সামর্থ্যের মধ্যে নান্দনিক পোশাক পরতে পারছে মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশে প্রভাব বাড়ছিল বিদেশি কাপড়ের। তার পরও কেউ কেউ সাহস করে উদ্যোগ নিয়েছেন। যেমন নিপুণের কথাই ধরা যাক। কুমিল্লার খাদিকে বৈচিত্র্যময় রূপে উপস্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালে এর যাত্রা শুরু। এর কর্ণধার ও ডিজাইনার আশরাফুর রহমানের দাবি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফ্যাশন হাউস নিপুণ। বললেন, ‘কোনো উদাহরণ ছিল না। আমরা ঠেকে ঠেকে শিখেছি।’

প্রথম থেকেই দেশি কাপড়ে লোকজ নকশা আর ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করতে থাকে ‘আড়ং’। ফলে অল্প দিনেই সাড়া জাগাতে সক্ষম হয় তারা। এখন তো টাঙ্গাইল শাড়ির খ্যাতি সর্বজনবিদিত। মুনিরা এমদাদের উদ্যোগে আশির দশকের শেষের দিকে টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির দেশীয় শাড়ির হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখে। দেশীয় ফ্যাশনে গ্রামীণ চেকের একটা বড় ভূমিকা ছিল। নব্বইয়ের দশকে বিবি রাসেল গ্রামীণ চেকের প্রচার ও প্রসারে দারুণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কম দাম, নান্দনিক নকশা আর আরামদায়ক বলে মানুষ সহজেই এটাকে লুফে নিল। নব্বইয়ের দশকে দেশীয় কাপড়ে নতুন ভাবনা নিয়ে এলো কে ক্রাফট, অঞ্জনস, রঙ (এখন রঙ বাংলাদেশ ও বিশ্বরঙ নামে বিভক্ত), নগরদোলা, দেশাল, বাংলার মেলা, প্রবর্তনা, বিবিআনা, সাদাকালোর মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। নতুন শতাব্দীতে শার্ট-পাঞ্জাবির পাশাপাশি তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টি-শার্ট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাকে স্বকীয়তার এক অনন্য চিত্র তৈরি করেছে নিত্য উপহার। প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার বাহার রহমানের মতে, টি-শার্ট হলো চলমান ক্যানভাস। কাইয়ুম চৌধুরী, কামরুল হাসান, হাশেম খান কিংবা ধ্রুব এষের মতো শিল্পীদের করা দেশজ ও লোকজ নকশার টি-শার্টগুলো এখনো তুমুল জনপ্রিয়। শুধু এককভাবে নয়, দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর যৌথ উদ্যোগও চোখে পড়েছে। যেমন—নিপুণ, রঙ, কে ক্রাফট, সাদাকালো, অঞ্জনসের মতো ১০টি দেশীয় ব্র্যান্ডের সম্মিলিত আয়োজন ‘দেশীদশ’। পরবর্তী সময়ে অন্যমেলা, এড্রয়েট, এম ক্রাফটের মতো আরো ১০টি ফ্যাশন হাউস নিয়ে ‘স্বদেশী’ গড়ে উঠেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের বয়নশিল্পে।

নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত মোটাদাগে পোশাক বলতে ছিল শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, পায়জামা-পাঞ্জাবি, শার্ট-প্যান্ট ইত্যাদি। পরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ফতুয়া, কুর্তি, টপসের মতো ফিউশনধর্মী পোশাক। শীতের পিঠার নানা ছাঁচ, নকশি কাঁথার ফোঁড়, আলপনা, রিকশাচিত্র, পুতুল, লক্ষ্মীসরার মতো লোকজ নকশা ও মোটিফগুলো ঘুরেফিরেই আসছে পোশাকে।

পথ দেখিয়েছিল বিচিত্রা

দেশীয় উদ্যোক্তাদের পোশাক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক বিচিত্রার বড় ভূমিকা ছিল বলে মনে করেন ডিজাইনার এমদাদ হক। বললেন, দেশীয় পোশাকের বিকাশের জন্য ক্রেতা তৈরি করা মোটাদাগে শুরু হয়েছিল ১৯৮৫ সালে ‘ঈদের বাজার’ দিয়েই। কারিকা, আড়ং, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, মুসা ডাইংয়ের মতো ফ্যাশন হাউসের পোশাকে ববিতা, চম্পার মতো তারকাদের ছবি ছাপা হয়েছিল বিচিত্রায়।  এরপর ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতাসহ নানা আয়োজন ছিল বিচিত্রার। দেশীয় কাপড়ের বাজার তৈরিতে এর বড় ভূমিকা ছিল।

 

ধারণা বদলেছে

বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই পোশাক কেনা হয় মৌসুমকেন্দ্রিক। শীতের কথা বাদ দিলে ঈদ, পূজা, পহেলা বৈশাখের মতো উৎসবকে ঘিরে জমে ওঠে দেশের পোশাকের বাজার। একসময়ের শৌখিন বুটিক হাউসগুলো এখন তো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড। ফ্যাশন হাউসগুলো আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বলেই ক্রেতারা দেশীয় কাপড়ে তৈরি পোশাক কিনছে। অঞ্জনসের প্রধান নির্বাহী শাহীন আহমেদ মনে করেন, ‘বিদেশি পোশাক মানে ভালো’—এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্রেতারা। দেশজ ও আন্তর্জাতিক উপকরণ আর নকশার মিশ্রণে পরিবেশিত হচ্ছে এখনকার পোশাক।’

 

গৌরব ফিরে আসছে

২০১৬ সালে জাতীয় জাদুঘরে দৃক, আড়ং ও জাতীয় জাদুঘরের যৌথ আয়োজনে ‘মসলিন উৎসব’ ছিল আশা-জাগানিয়া। ইতিমধ্যে গবেষকরা ফুটি কার্পাস তুলা দিয়ে মসলিন শাড়িও তৈরি করেছেন। জামদানির পর এখন ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মসলিন। ২০১৩ সালে ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে ইউনেসকো থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে জামদানি। দেশি কাপড় নিয়ে মানুষ এখন ভাবছে, যেকোনো উৎসব-আয়োজনে দেশি কাপড়ের পোশাক পরছে। দেশি বুটিক হাউসগুলো সেই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এটা বয়নশিল্পের জন্য দারুণ অর্জন বলে মানেন এমদাদ হক।

 

এখন দরকার

কাঁচামাল সুলভ না হলে যেকোনো শিল্পের সুষ্ঠু বিকাশ অসম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে তুলা, সুতা, রঙের মতো জরুরি উপকরণগুলো আমদানিনির্ভর। ফলে আমদানিনির্ভরতা কমানো জরুরি। সমকালীন বাস্তবতায় বিশ্বব্যাপী যে ফ্যাশন ট্রেন্ড চলছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদন করা এবং বিশ্ববাজারে এর প্রচার জরুরি। আশার কথা, তরুণ উদ্যোক্তা ও ডিজাইনাররা এ বিষয়ে এগিয়ে আসছেন।

Comments