৯ আগস্ট, আব্বু চলে যাওয়ার পর আমি ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বাইরে গাড়িতে বসে সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কানের মধ্যে বাবার কালজয়ী খুব পছন্দের গানের সুরগুলো বেজে উঠছে। আমি কিডনি রোগে ভুগছি অনেক দিন। এখন আমার দুটো কিডনিই প্রায় অকেজো। সামনেই কিডনি প্রতিস্থাপন করতে হবে। এই মুহূর্তে আমার রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম, তাই হাসপাতালে যাওয়া মানা।
আইসিইউতে আব্বু শুয়ে আছে, অনেকেই ততক্ষণে ভেতরে। আর আমি সন্তান হয়েও যেতে পারছি না। মনটা অস্থির। মা-র কথাও মনে পড়ছে। মাকে হারিয়েছি ৪ বছর প্রায়। কেমন যেন এতিম হয়ে গেলাম। আমার স্বামী কাজী ফায়সাল আহমেদ ভেতরে গেল, ওকে ফোন করে বললাম আব্বুকে যখন গোসল করাতে বের করবে, তখন আমি অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর আগে আব্বুকে দেখব। রাত সাড়ে আটটার দিকে আব্বুকে বের করা হলো হাসপাতালের বাইরে। এক দৌড়ে গিয়ে আব্বুকে দেখলাম। কী সুন্দর শুয়ে আছে, কথা বলে না! আব্বু দেখলেই আগলে ধরে চুমু দিত গালে। কিন্তু আব্বু কথা বলে না। হাসে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ফ্ল্যাশব্যাকে কত স্মৃতি যে ভেসে উঠছিল। নিজেকে একদম সামলাতে পারিনি। সবাই বাসায় পাঠিয়ে দিল। আমিও নিষ্ঠুরের মতো বাড়ি ফিরে এলাম।
আমি আমার বাবাকে তাঁর ক্যারিয়ারের একদম স্বর্ণকালে পেয়েছি। অর্থাৎ আশির দশকের শুরু থেকে। তাই বেড়ে উঠেছি কালজয়ী গানগুলোর মধ্যেই। আব্বু খুব আনন্দপ্রিয় মানুষ ছিল। বাসায় একদিকে সুর হচ্ছে সব ঐতিহাসিক গানের, অন্যদিকে নামীদামি শিল্পী, পরিবারের আরও সদস্যরা মিলে সবাই প্রায় প্রতি রাতে আড্ডা দিত। মা রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসতেন। পিকনিকের মতো পরিবেশ। রেকর্ডিংয়েও তা-ই হতো। যে শিল্পীর গান তিনি তো আছেনই, সঙ্গে আরও অনেক শিল্পী আব্বুর রেকর্ডিং দেখতে চলে আসতেন শ্রুতি স্টুডিওতে; যেটা আমার কাছে মনে হতো আব্বুর দ্বিতীয় বাসা। আমিও স্কুল থেকে অনেক সময় শ্রুতিতে যেতাম। অবাক হয়ে আব্বুর কাজ দেখতাম। কাজের সময় আব্বুর চেহারা হয়ে যেত গম্ভীর। অনেকেই নার্ভাস হয়ে যেতেন, কিন্তু আব্বু গেয়ে গেয়ে বুঝিয়ে গানগুলোর শ্রেষ্ঠ আউটপুট বের করে আনত। আমার মনে আছে, আব্বু গানের আবেগের ওপর অনেক বেশি জোর দিত। গলার কাজ থাকলেই একটু পরপর অপ্রয়োজনীয় কাজ পছন্দ করত না। কীভাবে অনেক শিল্পী আর বাদ্যযন্ত্রীকে হ্যান্ডেল করতে হয়, তা আমি আমার ছোট চোখে দেখে শেখার চেষ্টা করতাম। গানের কাজ শেষ হলেই আব্বুর মুড বদলে যেত। আবার আনন্দ, ফুর্তি, খাওয়া-দাওয়া, সে এক এলাহী কাণ্ড!
খুব অল্প বয়স থেকে আব্বুর গানগুলো মনের ভেতর গেঁথে গেছে। তাই আমি আব্বুর অনেক গান শুনতে পারি না। অনেক স্মৃতি মনে পড়ে, খুব কষ্ট হয়। বাবার কাছ থেকে আবেগটা ১০০% পেয়েছি।
আব্বু ভালোবাসতে জানতেন। লিখতে লিখতে চোখ ভিজে যাচ্ছে। আমার কোনো কিছুতে কমতি রাখেনি ছোটবেলায়। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে, আমার অনেক জ্বর, আব্বু শ্রুতির রেকর্ডিং ফেলে বাসায় চলে এসেছিল কিছুক্ষণের জন্য। হাতে বিশাল এক খেলনা। সেটা পেয়ে আমি মহাখুশি। খাচ্ছিলাম না। দুপুরের খাবার খাইয়েই আবার স্টুডিওতে দৌড়।
তবে একটাই কথা বলব সেটা হলো, আব্বু গানের বিষয়ে ১০০ ভাগ নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। সারাটা জীবন গানের পেছনেই কাটিয়ে দিয়েছে। আর তাই তো তিনি আলাউদ্দীন আলী। তাই তিনি সবার এত শ্রদ্ধার আর সম্মানের।
আফসোস রয়ে গেল শেষের দিকে আব্বুর সঙ্গে কম দেখা হতো দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতির কারণে। তবে আবার দেখা হবে। মন খুলে গল্প করব। বাবার সুরেই বলি আবার কখন কবে দেখা হবে বলো, কত না বলা কথা বাকি রয়ে গেল। ভালো থেকো আব্বু। তোমাকে অনেক ভালোবাসি।