ভিয়েতনামের পদ্মবিলে

Comments · 1340 Views

হ্যানয়ের নই বেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করতে করতে স্থানীয় সময় বিকেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। এরপর ট্যাক্সি নিয়ে যাত্রা শুরু হলো হোটেলের উদ্দেশে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পরেই ভ্রমণক্লান্ত দুটি চোখ নিজের অজান্তেই খুঁজে নিল বিশাল ওয়েস্ট লেক। সন্ধ্যার আগে বড় বড় পদ্মপাতার আড়ালে তখন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে গোলাপি-সাদা পদ্ম। তখনো বুঝে উঠতে পারিনি, কী বিশাল পদ্মের সাম্রাজ্য আমার জন্য অপেক্ষা করছে!

যা হোক, হোটেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। পরিচ্ছন্ন হওয়ার কিছুক্ষণ পরে রুমে চলে এল খানিকটা লালচে গোলাপি রঙের এক পেয়ালা চা। তিতকুটে স্বাদের হলেও তাতে সুগন্ধি আছে বেশ। খানিকটা খটকা লাগলেও কয়েক চুমুকে পুরো চা শেষ করার পর শরীর বেশ সতেজ হয়ে উঠল। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করতে গিয়েও দেখি সেই একই ধরনের চা। এবার সন্দেহ দূর করতে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেসই করে বসলাম, এটা কিসের চা? স্বাদ এমন কেন? উনি মুচকি একটা হাসি দিয়ে জানালেন, সেটা পদ্ম-চা (ভিয়েতনামে ট্রা সেন নামে ডাকা হয়) এবং প্রাচীনকালে এটা শুধু রাজারাই পান করতেন। তাই রাজকীয় এই চা এখনো ভিয়েতনামের আমজনতা রাজাদের প্রতি মনে মনে সম্মান জানিয়েই পান করেন। কথাপ্রসঙ্গে ম্যানেজার আরও জানালেন, মূলত পদ্ম ফুলের পাপড়ি, রেণুর শুকনো গুঁড়ো গরম পানিতে ৫ থেকে ১০ মিনিট ধরে সেদ্ধ করার পর সতেজ পাপড়ি ও রেণু ছিটিয়ে এই চা পান করা হয়। তেতো স্বাদ দূর করতে অনেকেই মধু বা চিনি মিশিয়েও পান করেন। তবে অধিকাংশই মিষ্টি ছাড়া পান করে থাকেন।

ম্যানেজারের কাছে জানতে পারলাম, ভিয়েতনাম আর পদ্ম একে অন্যের পরিপূরক। সকালের নাশতা শেষ হতেই কাঁধে ক্যামেরা ও বড় একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বন্ধু ভ্যই ট্রন ড্যুই এসে হাজির। ওর সঙ্গে হ্যানয়ের আনফু নামক একটা জায়গায় যেতে হবে। উদ্দেশ্য একটা অনাথ আশ্রমে শিশুদের অরিগ্যামি শেখানো, খেলা করা এবং কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে আসা। সারা দিন শিশুদের সঙ্গে কাটানোর পর বেলা তিনটার দিকে পেটে প্রচণ্ড খিদে নিয়ে আমরা গেলাম কাছের এক স্থানীয় প্যাগোডায়, সেখানেই আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্ধু ড্যুই বলল, আজ বিশেষ খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয়েছে এবং সেগুলো সবই পদ্মের নানা অংশ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আমি আগ্রহ নিয়ে পদগুলো খাওয়া শুরু করতেই বন্ধু ড্যুই জানাতে লাগল, পদ্মের প্রতিটি অংশেরই (ফুল, বীজ, কাণ্ড, মূল, পাতা) চমৎকার ব্যবহার আছে ভিয়েতনামের খাদ্যসংস্কৃতিতে। পদ্মের নানাবিধ ব্যবহার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশের খাবারে এনেছে দারুণ বৈচিত্র্য।

এ সুযোগে জানিয়ে দিই সেদিন যা যা খেয়েছিলাম, সেগুলোর বিষয়ে। পদ্মের তৈরি মজাদার, বৈচিত্র্যময় ও ঐতিহ্যবাহী সেসব খাবার বিষয়ে আমি ভ্যই ট্রন ড্যুইয়ের কাছে জেনেছিলাম।আনফু পদ্মবিল, হ্যানয়, ভিয়েতনাম। ছবি: লেখকআনফু পদ্মবিল, হ্যানয়, ভিয়েতনাম। ছবি: লেখক

পদ্মপাতায় ভাত
ভিয়েতনামের ভাষায় একে কম সেন বলা হয়। পদ্মপাতায় মুড়ে ভীষণ সুগন্ধী, পুষ্টিকর ও আঠালো এ ভাত রান্না করা হয়। স্বাদ বাড়িয়ে তুলতে পদ্মবীজ যোগ করা হয়। পাতা থেকে নিঃসৃত রং ভাতকে খানিকটা সবুজ আভা দেয়। ভিয়েতনামিজরা এই ভাত ভীষণ পছন্দ করে।

পদ্মবীজের স্যুপ
চি হাট সেন নামে একে ডাকা হয় ভিয়েতনামে। কাঁচা অথবা শুকনো পদ্মবীজ এক থেকে দুই ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে এতে চিনির সিরাপ মিশিয়ে হালকা আঁচে জ্বাল দেওয়া হয়। স্যুপটা খেতে বেশ মিষ্টি স্বাদের। অনেকেই এর সঙ্গে বিভিন্ন বাদামের বীজ, চিংড়ি, কাঁকড়া, স্কুইড ও ডিম ব্যবহার করেন।পদ্ম-চা। ছবি: লেখকপদ্ম-চা। ছবি: লেখকআড্রো ইয়াখনি

ভিয়েতনামের ঐতিহ্যবাহী ডেজার্ট এটি। পদ্মকাণ্ড, মূল ও পাপড়ি সেদ্ধ করে দুধ, দই, বিভিন্ন স্থানীয় মসলা, মাখন ও মধু দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। জ্বাল দিতে দিতে ঘন ক্রিমের মতো হয়ে এলে রেফ্রিজারেটরে রেখে ঠান্ডা করে খাওয়া হয়।

এর বাইরে পদ্মবীজ, মূল ও পাপড়ি দিয়ে তরকারি, নুডলস ও সালাদ বানিয়ে খাওয়া হয় ভিয়েতনামে। মধু, পদ্মের মূল ও পাপড়ি দিয়ে বানানো হয় অসাধারণ এক জেলি।পদ্মভাত বা কম সেন। ছবি: ভ্যই ট্রন ড্যুইপদ্মভাত বা কম সেন। ছবি: ভ্যই ট্রন ড্যুইখাওয়াদাওয়া শেষ করে খানিকটা বিশ্রাম নিয়েই বন্ধু ড্যুইয়ের গাড়িতে ছুটলাম পদ্মবিল ও পুকুর দেখতে। যাওয়ার পথে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সবুজ ধানের পুরু স্তরে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছিল। আলো নিভু নিভু অবস্থায় হ্যানয়ের আনফু পদ্মবিলের দেখা পেলাম। যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু পদ্মের সমারোহ। একে একে ফুটতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছিল যেন একঝাঁক তারা মিটমিট করে আলো দিতে শুরু করেছে। ছোট্ট নৌকায় চেপে বসে দুই বন্ধু ও নৌকার মাঝি পদ্মবিলের মাঝে চলে গেলাম। চারপাশে গভীর মিষ্টি সৌরভ ছড়াচ্ছিল পদ্মগুলো। ভালোবাসার আলতো পরশ বুলিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের হাতে। আমাদের ক্যামেরাও তখন স্মৃতি ধরে রাখায় ব্যস্ত। এক অপার্থিব আনন্দের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম সেই সাঁঝের বেলায়।

পদ্মবীজের স্যুপ বা চি হাট সেন। ছবি: ভ্যই ট্রন ড্যুইপদ্মবীজের স্যুপ বা চি হাট সেন। ছবি: ভ্যই ট্রন ড্যুইফেরার পথে গল্পে গল্পে বন্ধু জানাল, সেই ১৬০০ সাল থেকে ভিয়েতনামের রাজপ্রাসাদে পদ্মনাচের বিশাল কদর ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে ভিয়েতনামের স্কুলগুলোয় পদ্মনাচ টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভিয়েতনামে নতুন বছর উদ্যাপন করতে পদ্মগেট তৈরি করা হয়। সে দেশের অনেক সরকারি, বেসরকারি অফিস, বাড়িঘর, ধর্মীয় স্থাপনা, এমনকি ভিয়েতনাম এয়ারলাইনের লোগোতেও পদ্মের ছোঁয়া আছে। ঐতিহ্যবাহী টুপি নোনলা তৈরিতেও পদ্মপাতার ব্যবহার আছে। পদ্মের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে। তাই পদ্ম ভিয়েতনামের জাতীয় অর্থনীতিতে বেশ ভালোই ভূমিকা রাখছে।আড্রো ইয়াখনি। ছবি: ভ্যই ট্রন ড্যুইআড্রো ইয়াখনি। ছবি: ভ্যই ট্রন ড্যুইআরও মজার বিষয় জানলাম যে পদ্মের নাকি সিল্ক কাপড়ও তৈরি হয়। ভীষণ দামি এই কাপড়। পদ্মের ডাঁটা শুকিয়ে প্রায় ২৪ ঘণ্টা বিশেষ পদ্ধতিতে রেখে সুতো আলাদা করা হয়। বিশেষ করে উচ্চবিত্তরা পদ্মের সিল্কের কাপড় বিভিন্ন উৎসবে পরে থাকেন। এই বৈচিত্র্যময় সিল্কের কাপড় হ্যানয়ের হা গ্রামের ফান থি থুয়ানের হাতের কাজের শৈলীতে ভিয়েতনাম ছাড়িয়ে পৃথিবীর নানা দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

ভিয়েতনামিজদের জীবন ও সংস্কৃতিতে পদ্ম জড়িয়ে আছে বিভিন্নভাবে। ছবি: লেখকভিয়েতনামিজদের জীবন ও সংস্কৃতিতে পদ্ম জড়িয়ে আছে বিভিন্নভাবে। ছবি: লেখকস্থাপনা, জীবনযাপন, খাদ্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও উৎসবে মিলেমিশে একাকার হওয়া এবং শুদ্ধতা, প্রতিশ্রুতি ও ভবিষ্যতের প্রতীক পদ্ম ভিয়েতনামের জাতীয় ফুলের স্বীকৃতি নিয়ে গৌরবের সঙ্গে প্রকৃতিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

Comments