Back To Blogs | My Blogs | Create Blogs

মায়ের করোনা পরীক্ষা তো হলোই না, উল্টো মার খেলেন ছেলে


মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে আসেন ছেলে শাওন। পরীক্ষা তো করাতে পারেননি, উল্টো আনসার সদস্যদের মারধরের শিকার হয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত
মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ক্যানসারে আক্রান্ত মাকে নিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে আসেন ছেলে শাওন। পরীক্ষা তো করাতে পারেননি, উল্টো আনসার সদস্যদের মারধরের শিকার হয়েছেন তিনি। ছবি: সংগৃহীত
মায়ের করোনা পরীক্ষা করানোর জন্য মুগদা জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন রাজধানীর মুগদার দক্ষিণ মান্ডা এলাকার বাসিন্দা শাওন হোসেন। ভোর পাঁচটা থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও পরীক্ষা করানোর অনুমতি পাননি। এ নিয়ে কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে আনসার সদস্যরা তাঁর কলার ধরে হাসপাতালের ক্যাম্পে নিয়ে যান। এই ঘটনার ছবি তুলতে গেলে আনসার সদস্যরা লাঞ্ছিত করেন দুই ফটো সাংবাদিককে।

আজ শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় এই ঘটনা ঘটে। আনসার সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার শাওন হোসেন জানিয়েছেন, তাঁর মা ক্যানসারের রোগী। কেমোথেরাপি দিতে হলে করোনা শনাক্তের পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। লাইনের ক্রম অনুযায়ী তাঁর আজই পরীক্ষা করানোর কথা। অথচ অসুস্থ মাকে নিয়ে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও তাঁকে না করে দেওয়া হয়।
এই ঘটনায় হামলার শিকার দুই ফটোসাংবাদিক হলেন দেশ রূপান্তরএর রুবেল রশীদ এবং বাংলাদেশ প্রতিদিনএর জয়িতা রায়। আনসার সদস্যদের হামলায় রুবেল রশীদের ক্যামেরার লেন্সের ফিল্টার ভেঙে গেছে।

ভুক্তভোগী শাওন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত দুবার মুগদা হাসপাতাল থেকেই করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করিয়ে তিনি মাকে কেমোথেরাপি দিয়েছেন। গত ২০ জুন তৃতীয়বারের মতো বুথে পরীক্ষা করান। কিন্তু সময়মতো ফল না পেয়ে ২৩ জুন তিনি অভিযোগ বক্সে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। তার পরও ফল না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী ২৬ জুন তিনি নোটিশ বোর্ডে নোটিশ দিয়ে যান। পরদিন হাসপাতালে গিয়ে আবারও নোটিশ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হলে বৃহস্পতিবার পুনরায় তাঁর মাকে পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতাল থেকে বলা হয়।

শাওন হোসেন বলেন, করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালের সামনে দুটি লাইন থাকে। একটি লাইন যাঁরা বিনা মূল্যে বুথে পরীক্ষা করাবেন তাঁদের। অন্যটি যারা ২০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালে পরীক্ষা করাবেন তাঁদের। মাকে নিয়ে তিনি ভোর পাঁচটায় হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর লাইনে দাঁড়ান। লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিরা নিজেরাই একটি ক্রম করেন। সেই অনুযায়ী তাঁর ক্রম ছিল ৩৬ নম্বরে।

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা পরীক্ষার জন্য টোকেন দেওয়া শুরু করে। প্রথমে যাঁরা বিনা মূল্যে বুথে পরীক্ষা করাবেন তাঁদের টোকেন দেওয়া হয়। এরপর হাসপাতালে যাঁরা পরীক্ষা করাবেন তাঁদের টোকেন দেওয়া শুরু হয়। আনসার সদস্যদের হাতে মারধরের শিকার শাওন হোসেন বলেন, লাইনে অপেক্ষমাণ ব্যক্তিরা যাতে সুশৃঙ্খলভাবে টোকেন সংগ্রহ করেন, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আনসার সদস্যদের। কিন্তু তাঁরা কিছুই না করে ফটকে বসেছিলেন। তখন তিনি সবার সঙ্গে কথা বলে দায়িত্ব নিয়ে একজন একজন করে টোকেন সংগ্রহ করার জন্য পাঠাচ্ছিলেন। ৩৩তম ব্যক্তি যাওয়ার পরই যাঁরা টোকেন দিচ্ছিলেন তাঁরা আর টোকেন দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী অন্তত ৪০ জনকে তাঁদের টোকেন দেওয়ার কথা। তাঁর ক্যানসারআক্রান্ত মা ৩৬ নম্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

ছবি তুলতে গেলে ফটো সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন এক আনসার সদস্য। ছবি: সংগৃহীত

শাওন বলেন, টোকেন না দেওয়ার কারণ জানতে তিনি এগিয়ে যান। যাঁরা টোকেন দিচ্ছিলেন তাঁরা কোনো জবাব না দিয়েই সেখান থেকে চলে যান। তখন আনসার সদস্যদের কাছে তিনি কারণ জানতে চান। তাঁদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তাঁর কলার ধরে ভেতরের আনসার ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁকে লাঠি দিয়ে দুটি বাড়ি দেওয়া হয়। একজন আনসার সদস্য তাঁর হাত বাঁধার জন্য রশিও নিয়ে আসেন। পরে মুগদা থানা থেকে পুলিশ আসে। তারাও ঘটনার জন্য তাঁকে দায়ী করে। শেষমেশ তাঁর পূর্ণাঙ্গ নামঠিকানা লিখে নিয়ে যায়। এ নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা না বলার জন্যও শাসানো হয় তাঁকে।

ফটো সাংবাদিক জয়িতা রায় প্রথম আলোকে বলেন, সকাল সাড়ে ১০টায় তিনি মুগদা হাসপাতালে পৌঁছেই আনসার সদস্যদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে দেখতে পান। তখন ছবি তুলতে গেলে একজন আনসার তেড়ে আসেন। তাকে চড় মারতে উদ্যত হন। তিনি কোনো রকম সরে পড়লে চড়টি তাঁর গায়ে লাগেনি। তাঁর এই পরিস্থিতি দেখে এগিয়ে আসেন ফটোসাংবাদিক রুবেল রশীদ।

রুবেল রশীদ জানান, শাওন হোসেনকে কলার ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন আনসার সদস্যরা। সেই ছবি তুলতে গেলে এক আনসার সদস্য তাঁকে মারতে উদ্যত হন। এ সময় একটি চড় ক্যামেরায় লাগলে লেন্সের প্রটেক্টর ভেঙে যায়। এ সময় আনসার সদস্যরা খুব বাজে আচরণ করছিলেন বলেও জানান তিনি।

সাংবাদিকদের তোলা ছবি থেকে দেখা যায় দুজন আনসার সদস্য সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থেকে মায়ের করোনা শনাক্তের পরীক্ষা করাতে না পারা ছেলেটির কলার ধরে টানাহেঁচড়া করছেন। পেছন পেছন তাঁর মা হেঁটে যাচ্ছেন। এঁদের একজন আনসার সদস্য আফসারুল আমিন ফটো সংবাদিকদের ছবি তুলতে বাধা দিচ্ছিলেন। তবে লাঞ্ছিত দুই ফটোসাংবাদিক জানিয়েছেন সেখানে আরও কয়েকজন আনসার সদস্য ছিলেন যাঁরা খুব বাজে আচরণ করছিলেন।

ছেলেকে মারধর করতে করতে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আনসার সদস্যরা। তাকে রক্ষার জন্য পেছনে ছুটছেন মা। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনাস্থলে উপস্থিত মুগদা জেনারেল হাসপাতাল আনসার ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরীক্ষা করাতে না পেরে ছেলেটি (ভুক্তভোগী শাওন হোসেন) তাঁদের সঙ্গে অকথ্য ভাষায় কথা বলছিলেন। তখন সেখানে উপস্থিত একটি সংস্থার সাদাপোশাকের সদস্য ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যাম্পে নিয়ে যেতে বলেন। তাঁরা সেই কাজটিই করেছেন। পরে মুগদা থানার একজন উপপরিদর্শক এসে ছেলেটির নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে যান। ছেলেটিকে কোনো মারধর করা হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।

মুগদা হাসপাতালের করোনা পরীক্ষার টোকেন দেওয়ার বিষয়টি তদারকি করেন হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার অনিমেষ। একটি সূত্র থেকে তাঁর মুঠোফোন নম্বর সংগ্রহ করে ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর সামনে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। তাঁরা বুথ এবং হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর জন্য মোট ৫০ জন করে ১০০ জনকে টোকেন দিয়েছেন। সে হিসাবে লাইনের ৩৬ নম্বর যিনি দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর অবশ্যই পরীক্ষা করাতে পারার কথা। তাঁর দাবি, ক্যানসারআক্রান্ত কোনো রোগী থাকলে তাঁর কাগজপত্র দেখে সবার আগে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করেন তাঁরা।

তবে আনসার ক্যাম্পের সহকারী কমান্ডার রফিকুল ইসলাম জানান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সব সময়ই জরুরি প্রয়োজনের অজুহাতে পরীক্ষা করানোর কিছু টোকেন তাদের হাতে রেখে দেয়। আগে এই সংখ্যাটি ছিল ১৪-১৫ টি। এখন ৬-৭ টি রেখে দেওয়া হয়। আর লাইনে দাঁড়ানো মানুষজন তাঁদের ওপর চড়াও হন।

মুগদা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রলয় কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, অকথ্য ভাষায় কথা বলায় আনসার সদস্যরা একটি ছেলেকে টানাহেঁচড়া করেছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। তবে কোনো সাংবাদিককে মারধর করা হয়নি। গালমন্দ করে থাকতে পারেন। তবে এ নিয়ে কেউ তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ নিয়ে আসেননি।


Akash Ahmed  

124 Blog posts

Comments