সাত দিন ধরে জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত পবন দাসকে (৫০) মঙ্গলবার রাত ১১টায় নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে আনা হয়। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান কর্তব্যরত চিকিৎসক নিজাম উদ্দিন। রোগীর অবস্থা দেখে ফটকের সামনেই চিকিৎসা দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে না পেরে মৃতদেহের পাশেই ফটকের সিঁড়িতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়েন হতাশ চিকিৎসক। পাশে পবন দাসের স্ত্রীর আহাজারি। ছবি: সংগৃহীত
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পড়ে আছে নিথর দেহ। একপাশে উচ্চ স্বরে বিলাপ করছেন স্বজন। অন্য পাশে চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচাতে না পেরে মুষড়ে পড়া চিকিৎসক। করোনার দিনে এই ছবিটি কী বার্তা দেয় আমাদের?
হেরে যাওয়া মানুষ দেখেছেন? প্রশ্ন শুনেই নিশ্চয়ই উত্তর আসবে, এই দুনিয়ায় হারেনি কে? কোনো কোনো হার আমাদের আবার লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখায়। কোনো হার একেবারেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। আবার উঠে দাঁড়াতে আর ইচ্ছা করে না ক্ষণিকের জন্যও। ভাবনা আসে, থাকি না আর কিছুক্ষণ! চোখ ফেটে নামে রক্তরূপ অশ্রু। অস্ফুটে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে হাহাকারধ্বনি।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে পড়ে আছে নিথর দেহ। এক পাশে উচ্চ স্বরে বিলাপ করছেন স্বজন। অন্য পাশে চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচাতে না পেরে মুষড়ে পড়া চিকিৎসক। তিনি চেষ্টা করেছিলেন সর্বোচ্চ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তাঁর মুখ ঢাকা ছিল মাস্কে। তিনি কি কাঁদছিলেন? হয়তো ঘামে আর অশ্রুতে তখন হয়েছিল দারুণ সখ্য। দুটোই তো নোনা। ঘামের প্রতি কটাক্ষ হেনে অশ্রু হয়তো জানাচ্ছিল নিজের বিজয়গাথা।
বিলাপ এখন শোনা যায় সর্বত্র। কখনো মূল রাস্তার পাশের ঘুপচি গলিতে, কখনো বড় বড় দালানের সামনে। সময়েরও ঠিক নেই কোনো। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা অথবা গভীর রাতবিলাপের উপলক্ষ থেমে নেই। ভোর রাতে ভেঙে যায় ঘুম। কান উদগ্র হয়ে শোনে, কাঁদছে নাকি কেউ? যেন এখন কাঁদারই সময়! উদ্দাম হাসি নাকি পাখা মেলে হারিয়ে গেছে সুদূরে। হাজারো হারানো বিজ্ঞপ্তিও তাকে ধরিয়ে দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষের হাতে। আনন্দ এখন ফেরারি। তার পাত্তা কেউ পায় না।
মৃত্যু এখন হরেদরে মেলে। কারও উপসর্গ আছে, কারও নেই। কারও বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করে। ভাগ্যবান কেউ হাসপাতালে ঠাঁই পায়, কেউ ঢোকার মুখেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আবার কেউ ঢোকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ভেবে নেয়, আর কত? এবার না-হয় বিদায় নিয়েই ফেলি! কাঁহাতক আর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অপেক্ষমাণ থাকা যায়? কতক্ষণ আর জাদুর আশায় গাছের নিচে বসে থাকা যায়?
মৃত্যু এখন হরেদরে মেলে। কারও উপসর্গ আছে, কারও নেই। কারও বুক হাঁপরের মতো ওঠানামা করে। ভাগ্যবান কেউ হাসপাতালে ঠাঁই পায়, কেউ ঢোকার মুখেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। আবার কেউ ঢোকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ভেবে নেয়, আর কত? এবার না-হয় বিদায় নিয়েই ফেলি!
জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন মানুষের মৃত্যু হলে। তিনি বলেছিলেন:
মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব
থেকে যায়; অতীতের থেকে উঠে আজকের মানুষের কাছে
প্রথমত চেতনার পরিমাপ নিতে আসে।...
কিন্তু চেতনার পরিমাপে কী দেখা যায়? মানুষই তো মানুষের বড় হন্তারক। জীবাণু তো স্রেফ অজুহাত মাত্র। নিজেদের একটু লাভের আশায় যোদ্ধার জন্য দুই নম্বর বর্ম কিনি আমরা। শুধু কি দুই? কখনো কখনো তা তিন বা চারও পার হয়ে যায়! কখনো শিরস্ত্রাণে লোহার বদলে দিই পলকা প্লাস্টিক। এরপর তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে ঠেলে দিয়ে বলি, কুইক মার্চ!
যুদ্ধক্ষেত্রের আশপাশের গ্রামে তখন জ্বলে লেলিহান আগুন। যুদ্ধের নিয়মে গ্রামবাসী হয় কোলাটেরাল ড্যামেজ। কারণ তাদের বাঁচানোর জন্য যে পরিখা টানা হয়নি। তবে পরিখা টানার খরচটা নেওয়া হয়েছিল অনেক দিন ধরেই। দুর্যোগের দিনে তার হিসাব কে নেবে বলুন?
কেউই তাই হিসাব চোকায় না। হিসাবের খাতায় দেনা বাড়ে এক পক্ষের। একসময় দেনাদার যুদ্ধের আগুনে পুড়িয়ে ফেলে হিসাবের খাতা। চোখের পলক ফেলার আগেই মিলে যায় ডেবিট-ক্রেডিট। শুধু কিছু ছাই মনে করিয়ে দেয়, একদা হিসাবের এক লাল রঙা খাতা ছিল।
মনে পড়ছে বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো, চাকা কবিতাগ্রন্থের একটি কবিতার কথা:
ব্যর্থতার সীমা আছে; নিরাশ্রয় রক্তাপ্লুত হাতে
বলো, আর কতকাল পাথরে আঘাত করে যাব?
এখনো ভাঙেনি কেউ; ফুরিয়েছে পাথেয় সম্বল।
অথবা বিলীয়মান শবকে জাগাতে কোনো শিশু
সেই সন্ধ্যাকাল থেকে সচেষ্ট রয়েছে, তবু যেন
পৃথিবী নিয়মবশে নির্বিকার ধূসরতাধৃত।...
নির্বিকার এই চরাচরে আজ বিলাপই সম্বল। চাল-ডাল-তেল-নুনের চেয়েও সুলভে কেনা যাচ্ছে জীবন। শুধু দেহ পরিবহনের ন্যায্য দামে আর কোথায় পাবেন এত সাশ্রয়ী মূল্যের মৃত্যু?
তাই, কৃতজ্ঞ হোন। সাশ্রয়ী দামে মৃত্যুর জোগানদাতাদের লাইক দিয়ে, তাঁদের পাশে থাকুন। আকালের দিনে এটাই বা কম কী!