বিয়ের পর আমাদের প্রথম হানিমুন হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমার শ্বশুর আমার আর বউয়ের সাথে যেতে চাচ্ছেন। শাশুড়ি বারবার করে বলছেন, “ওদের মাঝে আপনি গিয়ে কি করবেন?”
“গেলে কি সমস্যা? সেন্টমার্টিন যাচ্ছে, আমার দেখার খুব শখ। আর তাছাড়া ওরা একা একা যাচ্ছে, একটা সেফটি আরকি!” বলেই বিতর্কে বিজয়ী হয়েছেন এমন একটা ভাব করলেন। এদিকে আমার রাগে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে।

বিয়ের পর থেকেই শশুর আমার আর আমার বউয়ের মাঝে ‘কাবাব মে হাড্ডি’ হয়ে বসে আছেন। তাঁর উৎপাতে বিয়েতে তোলা ছবির এলবামে আমি আর নীরা একসাথে একটি ছবিতেও নেই। যেগুলোতে আমরা একসাথে আছি, সেখানে তিনি আছেন। কোনটায় স্বেচ্ছায় পোজ দিচ্ছেন, কোনটায় হুট করে এসে পড়েছেন, কোনটায় ব্যাকগ্রাউন্ডে। এটুকুই শেষ নয়, বিয়ের রাতে প্রায় একটার দিকে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলেন, “জামাই, কয়েলটা দেয়া হয়নি, দরজাটা একটু খুলবে?” সেরাতে মোট তিনবার ফোন করে একবার কয়েল, আরেকবার পানির জগ-গ্লাস আর শেষবার একটা কাঁথা দিয়ে গেছেন।

বিয়ের পর থেকে উনার উৎপাত বহুগুণ বেড়েছে। শশুরবাড়ি আসলে সারাক্ষণ উনার রেডিও শুনতে হয়। কি নেই এই রেডিওতে! রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সব ধরণের বকবক এই রেডিওতে ফ্রি পাওয়া যায়। মডার্ণ প্রব্লেমের মডার্ণ সলিউশন প্রয়োজন, আমিও এই রেডিও বন্ধ করার সলিউশন বের করেছি। যখনি তিনি বকবক করা শুরু করেন, আমি বাবাকে টেক্সট করি উনাকে কল দিতে। এরপর বাবা কল দেন, রেডিও অন্যদিকে কনভার্ট হয়ে যায়। বেশ ক’দিন এই রেডিও শুনে শুনে বাবাও বিরক্ত হয়েছেন। তাই এখন তিনিও একটি মডার্ন সলিউশন বের করেছেন। তিনি এখন, “তো রাজনীতির কি হাল অবস্থা বেয়াই সাহেব?” বলে ফোন পাশে রেখে দেন। কাজকর্ম শেষ করে এসে আবার ফোন ধরে, “হুম। আচ্ছা। তো অর্থনীতির কি অবস্থা?” ব্যস! রেডিও চলে, বাবাও ফোন পাশে রেখে নিজের কাজ করেন। এভাবে আমি, বাবা দুজনেই বেঁচে যাই। বিজ্ঞানে জিনতত্ত্ব নামে একটি বিষয় আছে, অর্থাৎ পিতার আচার-আচরণ সন্তানের মধ্যে থাকে। তবে মাঝেমাঝে কিছু ব্যতিক্রম হয়, আর সেই ব্যতিক্রমের জন্যই আমি বেঁচে আছি। নয়ত, আমার ঘরে যদি ননস্টপ মিনি রেডিও চলত, তবে এতদিনে আমাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হত।

শ্বশুর আমাদের সাথে যাওয়ার ব্যাপারে বেশ সিরিয়াস দেখলাম। যাওয়ার আগের রাতেই সব গুছিয়ে রাখলেন। কার থেকে যেন একটা ক্যামেরাও ধার করে আনলেন। নিজের গোছগাছ শেষ করে তিনি আমাদের গোছগাছ দেখতে চলে এলেন। তারপর জ্ঞানীর মত পরামর্শ দিতে লাগলেন, “জামাই ক্যাডস নিও কিন্তু!”
“বাবা, আমরা সমুদ্রে যাচ্ছি, পাহাড়ে না”
“তাই তো!”
বলেই তড়িঘড়ি করে রুমে গিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা ক্যাডস জোড়া বের করে রেখে দিলেন। তারপর আবার এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “সুইমস্যুট কি নিব?”
হানিমুনে যাচ্ছি আমরা, অথচ উত্তেজনা তাঁর মধ্যে বেশি। “বাবা, ব্যস্ত হওয়ার দরকার নেই। আপনার ইচ্ছে করলে নিতে পারেন সুইমস্যুট”। তিনি কি বুঝলেন কে জানে, কিছু না বলে চলে গেলেন।

রাত বারোটার দিকে আমরা বাসে উঠলাম টেকনাফের উদ্দেশ্যে। আমার আর নীরার পাশাপাশি সিট। শ্বশুরের সিট টা আমাদের সিটের ডান সারিতে জানালার পাশে। বাস চলছে, মৃদু দুলুনি আছে, হাল্কা বাতাস বইছে, সেই বাতাসে নীরার চুল উড়ছে। আমি নীরার কাঁধে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছি আর ফিসফিস করে কথা বলছি দুজন। হঠাৎ করেই আমার পিঠে কারো স্পর্শ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি শ্বশুরমশাই। আমি তড়িঘড়ি করে সোজা হয়ে বসতেই তিনি কাচুমাচু হয়ে বললেন, “ইয়ে! আমার পাশের লোকটা খুব নাক ডাকছে, তার নাক ডাকার জন্য ঘুমুতে পারছিনা। তুমি ঐ সিটে গিয়ে বসবে একটু?” বেচারার চেহারায় কেমন একটা অসহায়ত্ব, দেখে আমার মায়া হল। আমি গিয়ে তাঁর সিটে বসলাম, তিনি বসলেন আমার সিটে। তারপর সারা রাত আমার শ্বশুর এমন নাক ডাকলেন, আশেপাশের কয়েক সিটের মানুষ সারারাত ঘুমুতে পারলো না।

আমরা টেকনাফ পৌঁছাই সকাল সাতটায়। টেকনাফ নেমেই আমাকে দৌড়াতে হল শ্বশুরের জন্য। তার প্রচণ্ড টয়লেট পেয়েছে। পাশে একটা পাবলিক টয়লেটে নিয়ে গেলাম। ছোট টয়লেট পাঁচ টাকা, বড় টয়লেট দশ টাকা। শ্বশুর ঢোকার আধঘণ্টা পর বেরিয়ে এলেন। দশটাকা বিল দিতেই কাউন্টারের মহিলা রেগে গেল। “আধা ঘন্টায় আমার কয়টা কাস্টমার হয় যানেন? চল্লিশ টাকা দেন”। শ্বশুর মশাই ঝগড়া লেগে গেলেন, “তোমরা তো টাইমের ভিত্তিতে ভাড়া দাওনা, ভাড়া দাও বড়-ছোট এই ভিত্তিতে, আমি যতক্ষণ থাকি- তোমার কি? কোয়ান্টিটি ম্যাটার করে এটা তো বলোনি!” আমি শ্বশুর কে থামালাম, শেষমেশ ঐ মহিলাকে ত্রিশ টাকা দিয়ে একটা হোটেলে ঢুকে হালকা নাস্তা করলাম। নাস্তার টেবিলেও শ্বশুরের অসুবিধা। টেবিল অপরিষ্কার কেন এটা নিয়ে ওয়েটারকে ডেকে দশ মিনিট পরিচ্ছ্বন্নতা বিষয়ক জ্ঞান দিলেন। তারপর সেখান থেকে কোনমতে খেয়েদেয়ে লঞ্চে উঠলাম।

ভিআইপি কেবিনে শ্বশুরকে বসিয়ে আমি আর নীরা ডেকের দিকে যেতেই শ্বশুর আটকালো। “আমি দাবা নিয়ে এসেছি সঙ্গে করে, একা খেলবো নাকি?” অগত্যা বসতে হল। আমি একটু তাড়াতাড়ি চাল দিচ্ছিলাম, খেলা শেষ করার জন্য। শ্বশুর রেগে গেলেন, “এইযে তুমি বিশ সেকেন্ড না হতেই চাল দিয়ে দিচ্ছ, এটা কি প্রমাণ করছে না যে তুমি পরিকল্পনাহীন চাল দিচ্ছ?” তারপর খেলা বন্ধ রেখে ত্রিশ মিনিট পরিকল্পনা বিষয়ক বক্তব্য দিলেন।

নীরা অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো, “বাবা, চলো না সমুদ্র দেখে আসি”
“সে তো দেখবোই। সমুদ্র দেখবো বলেই তো যাচ্ছি সেন্ট-মার্টিন”
“কিন্তু বাবা, লঞ্চ কিভাবে যাচ্ছে সমুদ্রের বুক চিরে, সেটা দেখাটা ইন্টেরেস্টিং হবে না? চলো দেখি!”
“এই, একটা ভুল কথা বললি। সমুদ্রের বুক চিরে মানে কি? সমুদ্রের বুক কি চেরা যায়? পানি তো আকার নেই, চিরবে কি করে!”
“বাবা, এটা একটা উপমা কেবল!”
“শোন, আকাশকুসুম উপমা দিলে বাক্য যোগ্যতা হারায়, জানিস?”
“জ্বি জানি। আচ্ছা আর উপমা দেব না। এবার চলো, সমুদ্র দেখে আসি”
“তুই যা, আমাদের খেলাটা শেষ হোক”

তাঁর শেষ বাক্যে আমার হৃদয় ভেঙে গেল। নীরাও উপায়ন্তর না দেখে বসে রইল। খেলা চলতে থাকলো, তিনি বেশ অনেকক্ষণ ভেবে ভেবে চাল দিতে লাগলেন। এভাবে যখন সেন্টমার্টিন এসে পৌঁছেছি, তখন সবার হৈ হৈ এ খেলা ভাঙলো। খেলা কিন্তু শেষ হয়নি, তখনো শ্বশুরেরই চাল ছিল।

সেন্টমার্টিন নামার আগেই শ্বশুর চোখে চশমা পরে নিলেন। তারপর দ্বীপে নেমে আমরা হোটেলের দিকে চললাম। বেশ বিলাসবহুল একটা হোটেলে আমরা দুটো রুম নিলাম। একটা ডাবল বেড, একটা সিঙ্গেল বেড। শ্বশুরকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে আমরাও রুমে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ পর দরজায় নক শুনে দরজা খুলে দেখি শ্বশুর এসেছেন, “তোমাদের এখানে কি বারান্দা আছে? আমি একটু কাপড় শুকাবো”।
“কাপড় ধুয়েছেন নাকি?”
“হ্যাঁ। এইযে হেঁটে আসলাম, শার্টে বালিতে ভরে গেছে”

আমি মনে মনে ভাবলাম, সেন্টমার্টিনে যে পরিমাণ বালি, শ্বশুরের খুব আসা-যাওয়া পড়বে মনে হচ্ছে রুমে বারান্দায় কাপড় শুকানোর জন্য। দুপুরে খেয়েদেয়ে বিকেলে বের হলাম বীচে ঘুরতে। সমুদ্রের গর্জন, পানির ভিজিয়ে দেয়া, সূর্যকে সাগরের গিলে খাওয়া, সব মিলিয়ে অসাধারণ এক আবহ সেখানে। আমার ইচ্ছে হল ক’টি ছবি তুলি বউয়ের সাথে, আবার শ্বশুর ক্যামেরাও নিয়ে এসেছেন। কিন্তু আমার স্বপ্নকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়ে শ্বশুর আমাকে দিয়ে নিজের শ’খানেক ফটো তোলালেন। কতশত পোজের ছবি, এদিক বেঁকে-ওদিক বেঁকে, বসে, হাত ছড়িয়ে এমনকি ভি সাইন দিয়েও ছবি তুলেছেন। আমি মনে মনে বললাম, “শালার বুড়ো! আমার হানিমুন ধ্বংস করার আনন্দেই মনে হয় ভি সাইন দেখাচ্ছিস!” আর এই বুড়ো বয়সে এত ছবি তুলে করবেটা কি বুড়ো! বাবার মত তো তার ফেসবুক আইডিও নেই।

আমার এ ভাবনা কাল হল, রাতে দেখি আমার ফেসবুকে রিকোয়েস্ট এসেছে শ্বশুরের আইডি থেকে। প্রোফাইল পিকচারে আমার তোলা ছবি। আইডিতে গিয়ে দেখলাম, গত একঘণ্টার মধ্যেই ত্রিশবারের মতন তিনি প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করেছেন।

রাতে খাওয়াদাওয়া করার বেলায় আমরা টুনা মাছ অর্ডার করলাম। খাবার টেবিলে আমাদের সার্ভ করার জন্য একটা ওয়েটার বেশ বিনয়ী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্বশুর কথা বলা শুরু করলেন, “এ টুনা মাছ কি তুমি ধরেছো?”
“জ্বি না স্যার। আমরা এগুলো কিনে এনেছি”
“কার থেকে কিনেছো?”
“জ্বি, মাঝিদের থেকে”
“মাঝিরা সাগর থেকে ধরেছে?”
শ্বশুরের অদ্ভুত সব প্রশ্নে আমার গা জ্বলে গেল। ওয়েটার বেচারাও সম্মানার্থে উত্তর দিচ্ছে।
“জ্বি স্যার। সাগর থেকেই ধরেছে”
“এই মাছের কোন ইন্টেরেস্টিং স্টোরি আছে?”
“একচুয়ালি স্যার, প্রকৃত টুনা মাছ বাংলাদেশে পাওয়া যায়না। এখানে টুনা বলতে বড় সুরমাগুলোকেই বোঝানো হয়”
“মানে? এ টুনা নয়?”
“জ্বি টুনা। বড় সুরমাকে টুনা বলা হয় আরকি!”
“তার মানে এটা সুরমা মাছ?”
“জ্বি, বড়গুলো। প্রকৃত টুনামাছ শ্রীলংকায় পাওয়া যায়”
“কিন্তু তুমি তো বললে এগুলো জেলেরা এই সমুদ্র থেকে ধরেছে!”
“স্যার! এগুলো জেলেরা সমুদ্র থেকে ধরেছে। এগুলো বড় সুরমা, বড় সুরমাকে বাংলাদেশে টুনা বলা হয়”
“মানে তোমরা টুনা বলে সুরমা খাওয়াচ্ছ?”

একথা বলেই শ্বশুর উত্তেজিত হয়ে গেলেন। ম্যানেজারকে ডেকে গালাগাল দিতে লাগলেন আর তৎক্ষণাত ৯৯৯ এ ফোন দিতে গেলে আমি বাঁধা দিলাম। অনেক চেষ্টার পর তাঁকে শান্ত করে, বড় সুরমা দিয়ে ভাত খাইয়ে হোটেলে নিয়ে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তির পর রাতে মাত্র চোখ লেগে এসেছে এমন সময় শ্বশুর ফোন দিলেন, “জামাই! তোমাদের টয়লেটে পানি আছে? আমার টয়লেটে পানি নেই, বড় সুরমা তো পেটে যাওয়ার পর এদিক ওদিক নড়েচড়ে বোধহয় টুনা হয়ে গেছে,,,,