হতাশ হয়ে থাকলে একবার পড়ে থাকুনঃ
.
আমি আমেরিকায় এসেছি পড়াশোনা করতে। নর্থ
ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রির
মতো রসকষহীন একটি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি
নিতে হবে। কত দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী
কেটে যাবে। ল্যাবরেটরিতে, পাঠ্যবইয়ের
গোলকধাঁধায়।
মনে হলেই হূৎপিণ্ডের টিকটিক খানিকটা হলেও শ্লথ
হয়ে যায়।
নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটির ক্লাসগুলো যেখানে
হয়, তার নাম ডানবার হল। ডানবার হলের ৩৩
নম্বর
কক্ষে ক্লাস শুরু হলো। কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের ক্লাস। ছাত্রসংখ্যা পনেরো। বিদেশি
বলতে আমি এবং ইন্ডিয়ান এক মেয়ে—কান্তা।
ছাত্রদের মধ্যে একজন অন্ধ ছাত্রকে দেখে
চমকে উঠলাম। সে তার ব্রেইলি টাইপ রাইটার নিয়ে
এসেছে। ক্লাসে ঢুকেই সে বিনীত ভঙ্গিতে
বলল, আমি বক্তৃতা টাইপ করব। খটখট শব্দ হবে,

জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি। আমি হতভম্ব। অন্ধ
ছাত্ররা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এটা আমি জানি।
আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছু অন্ধ
ছাত্রছাত্রী আছে, তবে তাদের বিষয় হচ্ছে
সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজবিদ্যা বা দর্শন। কিন্তু
থিওরিটিক্যাল
কেমিস্ট্রি যে কেউ পড়তে আসে আমার জানা ছিল
না।
আমাদের কোর্স টিচারের নাম মার্ক গর্ডন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মস্তান লোক।
থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রির লোকজন তাঁর নাম শুনলে
চোখ কপালে তুলে ফেলে। তাঁর খ্যাতি প্রবাদের
পর্যায়ে চলে গেছে। তিনি লেকচার শুরু
করলেন। ক্লাসের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে
গেল। বক্তৃতার শেষে তিনি বললেন, সহজ
ব্যাপারগুলো নিয়ে আজ কথা বললাম, প্রথম ক্লাস
তো তাই।
আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কিচ্ছু বুঝতে
পারিনি। তিনি ব্যবহার করছেন গ্রুপ থিওরি, যে
গ্রুপ
থিওরির আমি কিছুই জানি না।
আমি আমার পাশে বসে থাকা আমেরিকান ছাত্রটিকে
বললাম, তুমি কি কিছু বুঝতে পারলে? সে বিস্মিত
হয়ে
বলল, কেন বুঝব না, এসব তো খুবই এলিমেন্টারি
ব্যাপার। এক সপ্তাহ চলে গেল। ক্লাসে যাই, মার্ক
গর্ডনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। কিচ্ছু বুঝতে
পারি না। নিজের মেধা ও বুদ্ধির ওপর যে আস্থা
ছিল
তা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রচুর বই জোগাড়
করলাম। রাতদিন পড়ি। কোনো লাভ হয় না। এই
জিনিস
বোঝার জন্য ক্যালকুলাসের যে জ্ঞান দরকার তা
আমার নেই। আমার ইনসমনিয়ার মতো হয়ে গেল।
ঘুমুতে পারি না। গ্রেভার ইনের লবিতে ঘণ্টার পর
ঘণ্টা বসে থাকি। মনে মনে বলি—কী সর্বনাশ!
দেখতে দেখতে মিড-টার্ম পরীক্ষা এসে
গেল। পরীক্ষার পর পর যে লজ্জার সম্মুখীন
হতে হবে তা ভেবে হাত-পা পেটের ভেতর
ঢুকে যাওয়ার জোগাড় হলো। মার্ক গর্ডন যখন
দেখবে বাংলাদেশের এই ছেলে পরীক্ষার
খাতায় কিছুই লেখেনি, তখন তিনি কী ভাববেন?
ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যানই বা কী ভাববেন?
এই চেয়ারম্যানকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন
বিভাগের সভাপতি প্রফেসর আলি নওয়াব আমার
প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে লিখেছেন—ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ যে অল্পসংখ্যক
অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তৈরি করেছে, হুমায়ূন
আহমেদ তাদের অন্যতম। অসাধারণ মেধাবী
ছাত্রটি
যখন শূন্য পাবে, তখন কী হবে? রাতে ভয়াবহ
দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। মিড-টার্ম পরীক্ষায়
বসলাম। সব মিলিয়ে ১০টি প্রশ্ন। এক ঘণ্টা
সময়ে
প্রতিটির উত্তর করতে হবে।
আমি দেখলাম, একটি প্রশ্নের অংশবিশেষের
উত্তর আমি জানি, আর কিছুই জানি না।
অংশবিশেষের
উত্তর লেখার কোনো মানে হয় না। আমি মাথা নিচু
করে বসে রইলাম। এক ঘণ্টা পর সাদা খাতা জমা
দিয়ে
বের হয়ে এলাম। পরদিন রেজাল্ট হলো। এ তো
আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় যে ১৫টি খাতা
দেখতে ১৫
মাস লাগবে। তিনজন এ পেয়েছে। ছয়জন বি। বাকি
সব সি। বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ পেয়েছে
শূন্য। সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে অন্ধ
ছাত্রটি। এ ছেলেটির নাম আমার মনে পড়ছে না।
তার
নামটা মনে রাখা উচিত ছিল।
মার্ক গর্ডন আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিস্মিত
গলায়
বললেন, ব্যাপারটা কী বলো তো?
আমি বললাম, কোয়ান্টাম মেকানিক্সে আমার
কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। এই হায়ার
লেভেলের কোর্স আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
: বুঝতে পারছ না তাহলে ছেড়ে দিচ্ছ না কেন?
ঝুলে থাকার মানে কী?
: আমি ছাড়তে চাই না।
: তুমি বোকামি করছ। তোমার গ্রেড যদি খারাপ
হয়,
যদি গড় গ্রেড সি চলে আসে, তাহলে তোমাকে
বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে
চলে যেতে হবে। গ্র্যাজুয়েট কোর্সের এই
নিয়ম।
: এই নিয়ম আমি জানি।
: জেনেও তুমি এই কোর্সটা চালিয়ে যাবে?
: হ্যাঁ।
: তুমি খুবই নির্বোধের মতো কথা বলছ।
: হয়তো বলছি। কিন্তু আমি কোর্সটা ছাড়ব না।
: কারণটা বলো।
: একজন অন্ধ ছাত্র যদি এই কোর্সে সবচেয়ে
বেশি নম্বর পেতে পারে, আমি পারব না কেন?
আমার তো চোখ আছে।
তুমি আবারও নির্বোধের মতো কথা বলছ। সে
অন্ধ হতে পারে, কিন্তু তার এই বিষয়ে চমৎকার
ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। সে আগের কোর্স
সবগুলো করেছে। তুমি করোনি। তুমি আমার
উপদেশ শোনো। এই কোর্স ছেড়ে দাও।
: না।
আমি ছাড়লাম না। নিজে নিজে অঙ্ক শিখলাম। গ্রুপ
থিওরি শিখলাম, অপারেটর অ্যালজেব্রা শিখলাম।
মানুষের অসাধ্য কিছু নেই এই প্রবাদটি সম্ভবত
ভুল
নয়। একসময় অবাক হয়ে লক্ষ করলাম কোয়ান্টাম
মেকানিক্স বুঝতে শুরু করেছি।
ফাইনাল পরীক্ষায় যখন বসলাম, তখন আমি জানি
আমাকে আটকানোর কোনো পথ নেই।
পরীক্ষা হয়ে গেল। পরদিন মার্ক গর্ডন একটি চিঠি
লিখে আমার মেইল বক্সে রেখে দিলেন। টাইপ
করা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে:
-তুমি যদি আমার সঙ্গে থিওরিটিক্যাল কেমিস্ট্রিতে
কাজ করো তাহলে আমি আনন্দিত হব এবং তোমার
জন্য আমি একটি ফেলোশিপ ব্যবস্থা করে দেব।
তোমাকে আর কষ্ট করে টিচিং অ্যাসিসটেন্টশিপ
করতে হবে না।
একটি পরীক্ষা দিয়েই আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে
পরিচিত হয়ে গেলাম।
পরীক্ষায় কত পেয়েছিলাম তা বলার লোভ
সামলাতে পারছি না। পাঠক-পাঠিকারা আমার এই
লোভ
ক্ষমার চোখে দেখবেন বলে আশা করি।
আমি পেয়েছিলাম ১০০ তে ১০০।
বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন
বিভাগের
কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি পড়াই। ক্লাসের শুরুতে
ছাত্রদের এই গল্পটি বলি।
শ্রদ্ধা নিবেদন করি ওই অন্ধ ছাত্রটির প্রতি,
যার
কারণে আমার পক্ষে এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল।

লেখাঃ-হুমায়ূন আহমেদ