রেড জোন করে লকডাউনের ফল ভালো

Comments · 1253 Views

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ড গত ১৩ জুন থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন করা হয়। এসব ওয়ার্ডে করোনা সংক্রমণের হার ছিল খুব বেশি। তাই এসব এলাকাকে 'রেড জোনের' মধ্যে ফেলে এই লকডাউন কার্যকর করা হয়। পৌরসভার ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডে লকডাউন এখনো চলছে। এখন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত, এটি চলবে ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু এরই মধ্যে দেখা গেছে সংক্রমণের মাত্রা এখানে অনেকটাই কমে গেছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. ছাদেকুর রহমান আকন্দ আজ সোমবার প্রথম আলোকে বললেন, 'প্রথম দিকে যেমন বেশি বেশি ছিল সংক্রমণের হার ছিল এখন তেমন নেই। আগের চেয়ে টেস্টও অনেক বাড়িয়েছি। এখন যেই নমুনা দিতে চান, তারটাই আমরা নিচ্ছি। এসব লোক হয়তো অন্যের সংস্পর্শে গেছেন। কিন্তু পজিটিভ লোক খুব কমই পাচ্ছি।'

উপজেলা স্বাস্থ্য অফিস সূত্র জানায়, এই তিন ওয়ার্ড থেকে ২৫ জুন ১৯ জনের নমুনা নেওয়া হয়েছিল। পজিটিভ আসে চারজনের। পরদিন ২৬ জুন ১৪ জনের নেওয়া হয়ছিল। একজনেরও পজিটিভ আসেনি। পরদিন ২৩ জনের মধ্যে দুজনের পজিটিভ পাওয়া গেছে।

Lifebuoy Soap
শুধু গাজীপুরের এই রেড জোন না। এ পর্যন্ত যেসব এলাকাকে রেড জোন করে লকডাউন করা হয়েছিল তার সবখানেই এমন সুফল পাওয়া গেছে।

দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম কোভিড১৯ রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এ পর্যন্ত মোট শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪১ হাজার ৮০১ জন। আজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে চার হাজার ১৪ জন নতুন করে আ্রক্রান্ত হয়েছে। দেশের করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এ সংখ্যা সর্বোচ্চ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ৪৫ জন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। সাধারণ ছুটি বা এক ধরনের লকডাউনের মধ্যে সংক্রমণের হার বাড়ছিল। কিন্তু ৩০ মে সরকারি ছুটি শেষ হওয়ার পর শনাক্তের সংখ্যা এবং সংক্রমণের পরিমাণ ব্যাপক হয়। সবকিছু খলে দেওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকে ২০ দিনে রোগী দ্বিগুণ হয়েছে। গত ২০ দিনে ৭০ হাজার নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এরই মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় পরে সারা দেশকে লাল, হলুদ ও সুবজ জোনে ভাগ করে এলাকাভিত্তিক লকডাউন দেওয়া শুরু করে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে। কিন্তু তা বিচ্ছিন্নভাবে। তবে সেসব বিচ্ছিন্ন উদ্যোগেও সাফল্য এসেছে।

এখন সংক্রমণের যে অবস্থা তাতে অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন একটি অপিরহার্য উদ্যোগে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, 'এখন ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অঞ্চলভিত্তিক লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই। এর সুফল মিলছে।'

দেশে একেবারে শুরুতে ১৯ মার্চ প্রথম লকডাউন করা হয় মাদারীপুরের শিবচর উপজেলাকে। কাগজেকলমে শিবচর পৌরসভার দুটি ওয়ার্ড এবং দুই ইউনিয়নের দুটি ওয়ার্ড মিলিয়ে চারটি ওয়ার্ড লকডাউনের কথা থাকলেও আসলে পুরো উপজেলাই লকডাউন করে ফেলা হয়। মাদারীপুরের সিভিল সার্জন মো. শফিকুল ইসলাম আজ প্রথম আলোকে বলেন, 'সেই সময় লকডাউনের সুফল এখন আমরা পাচ্ছি। মাদারীপুরের চার উপজেলার মধ্যে এখন সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে কম আক্রান্ত শিবচরে।'

জেলা প্রশাসনের হিসাবে, মাদারীপুরের চার উপজেলার মধ্যে এখন সদর উপজেলায় সর্বোচ্চ রোগীর সংখ্যা ২৫২, রাজৈরে ২১৯, কালকিনীতে ১৩০ এবং শিবচরে ১০৮।

সিভিল সার্জন বলেন, 'ওই লকডাউনের সময় যে কাজ হয়েছে তা অনন্য। লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার আইইডিসিআর থেকে একটি চৌকষ দল আসে। তারা স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে ঘরে ঘরে গিয়ে সন্ধান চালায়। মানুষের এক ধরণের ওরিয়েন্টশন হয়। এর ফল আমরা পেয়েছি। আমরা সংক্রমণ কমাতে সমর্থ হয়েছি। লকডাউনের কোনো বিকল্প নেই।'

শিবচেরর পরপরই ২৩ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের টোলারবাগ এলাকায় লকডাউন করা হয়। ২১ ও ২২ মার্চ পর পর দুজন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। রাজধানীর বেশি সংক্রমিত এলাকার মধ্যে একটি ছিল এই টোলারবাগ। এই তিন হাজার জনসংখ্যার এলাকায় আক্রান্ত ছিলেন ১৭ জন। ১০ এপ্রিলের মধ্যে সবাই সুস্থ হয়ে ওঠে।

স্থানীয় ১২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার মুরাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, 'এলাকার মানুষের সহযোগিতা ছিল বলে আমাদের সাফল্য এসেছিল।'

ঢাকা উত্তর সিটির আরেক এলাকা পূর্ব রাজাবাজারে এখনো লকডাউন চলছে। এলাকাটিতে থাকেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। একপর্যায়ে এখানে ব্যাপক সংক্রমণ শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৯ জুন মধ্যরাত থেকে এই রেড জোন এলাকায় লকডাউন শুরু হয়। ৩০ জুন এই এলাকায় লকডাউনের ২১ দিন পূর্ণ হবে। আইইডিসিআর এই লকডাউন ব্যবস্থা দেখভাল করছে। আর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়।পূর্ব রাজাবাজার উত্তর সিটির ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে পড়েছে। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, এ এলাকায় প্রথমে ৩১ জন সংক্রমিত ছিল। তিন দিনে বেড়েছে আরও ১৯ জন। এরা আগে থেকেই আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু টেস্ট করেন নি। সন্দেহজন যাকে মনে হয়ে তাকেই টেস্ট করেছি। প্রথম ১৪ দিনে ৩৫ জন সুস্থ হয়ে গেছে। বাকি ১৫ জনের মধ্যে আটজন সুস্থ হয়ে গেছে। বাকিরাও সুস্থ, তবে তাদের পরীক্ষার রিপোর্ট আসলেই নিশ্চিত হওয়া যাবে।'

পূর্ব রাজাবাজারে এখনো পুরো পাড়াটি লকডাউনের পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে ২২টি বাড়িকে কাউন্সিলের তত্ত্ববধানে বিশেষভাবে নজরদারি করা হয়। এসব বাড়িতে আক্রান্তরা ছিলেন। বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের জোগান দিতে সহযোগিতা করা হয় কাউন্সিলর অফিসের পক্ষ থেকে। এলাকার নাজনিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বুথ বসিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এখানে কাজ করেন ২০০ স্বেচ্ছাসেবী।

আর এই পূর্বরাজাবাজারে আইইডিসিআরের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। সংস্থার উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, 'প্রথমে আইইডিসিআর ২০ জনকে ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষণ দেয়। পরে মোট ২০০ স্বেচ্ছাসেবী এখানে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করেছে। আমরা ভালো ফলাফল পেয়েছি।'

চলতি মাসের শুরুতে দেশের সংক্রমিত এলাকাগুলোকে লাল, সবুজ ও হলুদ জোনে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই এই জোনিং হয়। ঢাকার বাইরে এসব এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় লকডাউনের দায়িত্ব দেওয়া হয় জেলার প্রশাসক, সিভিল সার্জন ও পুলিশ সুপারকে। এক্ষেত্রে সিভিল সার্জনের বিবেচনাকে মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

সংক্রমণের ব্যাপকতায় ঢাকার বাইরে নরসিংদীর মাধবদী পৌরসভার ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডকে রেড জোনে ফেলে লকডাউন করা হয় ১২ জুন। পৌরসভার ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডে লকডাউন শেষ হবে ২ জুলাই। নরসিংদীর সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইব্রাহিম টিটন আজ বলেন, 'দুটি ওয়ার্ডে শুরুতে ১৮ জন সংক্রমিত ছিল। এখন তা কমে ৩ নেমে এসেছে। আমরা আশানুরূপ সাফল্য পেয়েছি।'

ঢাকার পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের রূপগঞ্জ ইউনিয়েনর প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা জুড়ে লকডাউন এখনো চলছে। এটি শুরু হয়েছিল ১২ জুন। জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইমতিয়াজ জানান, রেড জোন করে লকডাউনের আগে এখানে পজিটিভ রোগী ছিলেন ৮১ জন। এর মধ্যে ৭৭ জনই সুস্থ হয়ে গেছে। ১৯ দিনে নতুন করে আক্রান্ত হয়েছে ৩৫ জন। তাদেরও প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু রিপোর্ট এখনো আসেনি। দুইদিনের মধ্যেই চলে আসবে।

সিভিল সার্জন ইমতিয়াজ অবশ্য বলেন, 'এলাকার লকডাউনে সাফল্য যেটা পেয়েছি এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু এলাকাটি শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এটা মেনে চলাটা জটিল হয়ে গেছে। তারপরও সাফল্য এসেছে।'

গত ১৩ জুন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একাধিক ওয়ার্ড এবং তিন জেলার বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। করোনা প্রতিরোধে গঠিত কেন্দ্রীয় টেকনিক্যাল কমিটি এসব এলাকাকে চিহ্নিত করে। ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটির মোট ৪৫টি এলাকাকে 'রেড জোন' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির ১৭ এবং দক্ষিণ সিটির ২৮টি এলাকা আছে। আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১১টি এলাকা রেড জোনের মধ্যে পড়েছে।

এখন ঢাকার দুই সিটিতে সংক্রমণ যে রূপ নিয়েছে তাতে বিচ্ছিন্নভাবে নয় একেবারে প্রতিটি রেডজোনে একযোগে লকডাউন জরুরি বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন। কিন্তু এটা জরুরি হলেও এখনো পর্যন্ত হচ্ছে না কেন? এর জবাবে মুশতাক হোসেন বলেন, 'এখন অনেকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিঘ্ন হবে বলে অজুহাত দেখান। কিন্তু লকডাউন করে রোগ না নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে আমরা আরও ভয়াবহ বিপদে পড়ব।'

ঠিক এমনটাই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে বাাঁচতে হবে। করোনা নিয়ন্ত্রণ না হলে অর্থনীতিও সবল হবে না। শুধু দেশের না আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।'

অধ্যাপক হামিদ বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে আঞ্চলিক লকডাউন নয়। চিহ্নিত এলাকাগুলোতে একযোগে লকডাউন করতে হবে।

Comments