করোনা সংক্রমণ বাংলাদেশে ঘাঁটি গেড়ে বসার পর গত ২৫ মার্চ সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে নির্দেশনা অনুযায়ী আর সচেতনতার অংশ হিসেবে ঢাকাতেই অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাড়িতে বৃদ্ধ পিতামাতা এবং পরিবারের অন্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে সেই মুহূর্তে আর বাড়ি যেতে মন চাইল না। ঢাকায় আমি থাকি মেসে। মেসের দুজনের অফিস বন্ধ হয়ে গেলেও অন্য দুজন সদস্যের একজন ব্যাংকার, আরেকজন একটি ভোগ্যপণ্য বিপণন প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন বলে তাঁদের তখনো অফিস করতে হতো। আমরা সবাই চেষ্টা করেছি সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে।
কাজের বুয়াকে পূর্ণ বেতনে ছুটি দিয়ে নিজেরাই রান্নাবান্নার কাজ ভাগ করে নিয়েছিলাম। সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেন চলতে চেষ্টা করতাম। তবু রমজান মাসের শেষ দিকে ১৮ মে, প্রথম একজনের জ্বর দেখা দিল। আমরা তখন করোনাকে সন্দেহের তালিকায় নিইনি। সিজনাল ফ্লু মনে করেছিলাম। ঠিক চার দিন পর ২২ মে দ্বিতীয়জনের জ্বর এল। সেটাকেও ঠান্ডা জ্বর আর সিজনাল ফ্লু হিসেবে গণ্য করে কেবল প্যারাসিটামলের ওপর আস্থা রাখলেন তাঁরা। এর দুই দিন পর ২৪ মে জ্বর এল আমার। মানুষের মনে ইতিবাচক চিন্তাই আগে কাজ করে। আমিও তাই ভাবলাম মাস্ক পরে রোদের মধ্যে বাজার করেছি, রোদ থেকে এসেই গোসল করেছি, তাই হয়তো ঠান্ডা লেগেছে। এ নিশ্চয় তেমন কিছু না। বলা বাহুল্য, জীবনে এবারই প্রথম বাবা মা পরিবার ছেড়ে অনেক দূরে ঈদ করছি। মনটা এমনিতেই খারাপ।
তিনজনে মিলে চেষ্টা করছি যথাসম্ভব ঘরোয়া পরিবেশ বজায় রাখার, মন ভালো রাখার। ইউটিউব দেখে আর নিজেদের বিদ্যা কাজে লাগিয়ে ঈদের খাবারদাবার আয়োজন করার চেষ্টা চলছিল। অন্য দুজনের জ্বর থাকায় রান্নার ভার আমার ওপর পড়েছিল পূর্বনির্ধারিতভাবে। তাই শরীরে হালকা জ্বর বোধ করলেও ডাবল প্যারাসিটামল খেয়ে মনের জোরে সুস্থ থাকার চেষ্টা করছিলাম। পরদিন ২৫ মে, এই জ্বরজ্বর বোধ নিয়েই রান্না করলাম। তারপর থেকে শরীর আর বিশেষ সায় দিল না। শখ করে রাঁধলেও খেতে পারলাম না খুব একটা। ইচ্ছেই করল না। ভাবলাম রান্নাবান্না করে মনে হয় বেশি ক্লান্তি এসেছে, বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। পরদিন জ্বর তেমন ছিল না, তবে মাথাব্যথা শুরু হলো।
ওদিকে ঘরের অন্য সদস্যদের জ্বর শুরু থেকেই কমছিল না। ওষুধ খেলে একটু কমে আবার দুইএক ঘণ্টা পর জেঁকে বসে। মেসের মধ্যে তিন স্বজনহীনপরিবারহীন মানুষ, সবাই অসুস্থ! কী যে অসহায় একটা অবস্থা! এরই মাঝে একজনের নতুন উপসর্গ, একটু একটু শ্বাসকষ্ট বোধ করছিল এবং জিবে স্বাদ পাচ্ছিলেন না তিনি। ওদিকে আমারও সারা দিন জ্বরজ্বর বোধ হয়, মাথা ও শরীর ম্যাজম্যাজ করে। এবার আমরা একটু নড়েচড়ে বসলাম বৈকি। এত দিন পাত্তা দিইনি তেমন। এবার পরিচিত এক চিকিৎসকের কাছে ফোনে পরামর্শ চাইলে তিনি কোভিড-১৯ পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন। এক রুমের দুজনেরই যেহেতু জ্বর, তাই দুজনেই একসঙ্গে পরদিন ২৭ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিভার ক্লিনিকে রেজিস্ট্রেশন করে ২৮ মে ডাক্তার দেখিয়ে স্যাম্পল দিয়ে এলাম। তারপরও আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এ রকম সাধারণ উপসর্গে করোনা পজিটিভের আশঙ্কা নেই। নিশ্চয় এটা মামুলি জ্বর।
এতক্ষণ বলিনি, আমি একজন টাইপ-১ ডায়াবেটিসের রোগী। মানে, সেই ছোটবেলা থেকেই আমার ডায়াবেটিস আর আমাকে নিয়মিত ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়। বারডেমের ডাক্তার বেদৌরা ম্যাডামের কাছে নিয়মিত ফলোআপ করি বলে তাঁকেও পুরো বিষয়টি ফোনে জানালাম এবার। তিনি রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। আদা, লেবু, লবঙ্গ দিয়ে গরম পানি খেতে বললেন। আশ্বস্ত করলেন। কেন যেন আমাদের মনে তখনো বিশ্বাস ছিল যে আমাদের কোভিড নেগেটিভ আসবে। কিন্তু আশার গুড়ে বালি দিয়ে রাত সাড়ে নয়টায় দুজনের মোবাইলে একসঙ্গে ম্যাসেজ এল যে প্রত্যেকে কোভিড-১৯ পজিটিভ!
আইসোলেশনে যা করেছি
ভাঙা মন নিয়ে অনেকক্ষণ বসে ছিলাম দুজন। পরিবারপরিজন বহু দূরে। শহরজুড়ে লকডাউন। ভারি একা আর অসহায় লাগছিল। কিন্তু ভেঙে পড়লে চলবে না। একাই করোনার সঙ্গে লড়তে হবে। একটু ধাতস্থ হয়ে প্রথমে আমার নিয়মিত ডায়াবেটিসের চিকিৎসককে আর পরে পরিচিত সিএমএইচের করোনা ইউনিটের একজন চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম। তিনি আমার টাইপ-১ ডায়াবেটিসের কথা ভেবেই হয়তো তক্ষুনি হাসপাতালে ভর্তি হতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আমি জানতে চাইলাম, বাসায় থেকেই চিকিৎসা নেওয়ার কোনো উপায় আছে কি না। তিনি তখন আমাকে ফোনেই ব্যবস্থাপত্র দিলেন আর আইসোলেশনে সাবধানে থাকতে বললেন।
মেসে আমরা আক্রান্তরা নিজেদের আলাদা করে নিলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ননকোভিড সদস্যরাই সরবরাহ করতেন। প্রতিদিনি দুজন চিকিৎসককেই মেসেজ পাঠিয়ে আপডেট জানাতাম। চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে অক্সিজেন সেচুরেশন মাপার জন্য পালস অক্সিমিটার কিনে নিলাম। কারণ সেচুরেশন ৯৩এর নিচে নেমে গেলে অক্সিজেন সাপোর্টের দরকার হতে পারে আর হাসপাতালে যেতে হবে, এ বিষয়ে তাঁরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ জন্য দিনে কয়েকবার সেচুরেশন মেপে তাঁদের জানাতাম। আমার সেচুরশেন ৯৫ থেকে ৯৬ শতাংশে ওঠানামা করছিল। তাঁরা বললেন, ভয়ের কিছু নেই। ওষুধের পাশাপাশি সহায়ক হিসেবে প্রতিদিন আদা, লেবু, লং, দারুচিনি, কালিজিরা, মধু দিয়ে দিনে চার-পাঁচবার গরম পানি পান করি। দুইতিনবার গরম পানির ভাপ নিই। নিয়মিত শ্বাসের ব্যায়ামগুলো করি। প্রচুর আমিষ যেমন, দুধ, ডিম, মাংস, ডাল ও ভিটামিন সি যেমন, লেবু, মালটা, সিভিট খেতে থাকি।
এ সময় নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করেছি, বিশ্রাম নিয়েছি ও মনকে রিলাক্স রাখতে অনেক বই পড়েছি। প্রিয়জনদের সঙ্গে মোবাইলে গল্প করেছি, সিনেমা দেখেছি। আর বড় ব্যাপার হলো, আমরা যেহেতু তিনজন একসঙ্গে আইসোলেশনে ছিলাম, তাই বিশেষ একাকিত্ব বা মানসিক চাপ অনুভব করিনি।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের জন্য যা করেছি
আমি ইনসুলিন পাম্প ব্যাবহার করি। এটি একটি যন্ত্রবিশেষ, যা পেটের চামড়ার নিচে লাগানো থাকে আর সব সময় এটা থেকে ইনসুলিন শরীরের ভেতর প্রবেশ করে। এটি একটি আধুনিক প্রযুক্তি। রমজান মাসে রোজা রাখার কারণে মাঝেমধ্যেই সুগার কমেবেড়ে যাচ্ছিল। কয়েকবারই এর ব্যাজাল কনফিগারেশন পরিবর্তন করতে হয়েছে। মাঝেমধ্যে নিয়ম পালন না করার কারণে বা ফলমূল ও শরবতের পরিমাণ এদিকসেদিক হওয়ায় হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা হাইপারগ্লাইসেমিয়া হয়েছে।
করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর আর ঈদের খাবার খেয়ে রক্তে সুগারের পরিমাণ প্রথম দুই দিন হঠাৎ একটু বেশি বেড়ে গিয়েছিল। অষ্টম দিন পর্যন্ত রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণে ছিল, কিন্তু আবার কেন যেন নবম থেকে ১৩তম দিন সুগার মাঝেমধ্যেই বেড়ে যাচ্ছিল। তাই বারবার আমাকে ইনসুলিন পাম্পের ব্যাজাল ও বোলাস পরিবর্তন করতে হচ্ছিল। ১৪তম দিন থেকে সুগার আবার আগের মতো নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় আমি দিনে চার-ছয়বার রক্তের সুগার পরীক্ষা করেছি। সার্বক্ষণিক ডায়াবেটিসের চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছি। কারণ আমি পড়েছি যে, ডায়াবেটিস করোনার জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে। আর আমার বয়স কম হলেও রুমের অন্য দুজনের তুলনায় আমার ঝুঁকি অনেক বেশি। আমি ডায়াবেটিসকে তাই একদম সুযোগ দিতে চাইনি।
জীবনযাপন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন
করোনা হওয়ার পর আমি সবচেয়ে বেশি যেটা অনুভব করেছি তা হলো, মানসিক শক্তি এ সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীবনযাপনের যে স্বাভাবিক নিয়মগুলো অন্য সময় নানা কাজের চাপে প্রায় ভুলতে বসেছিলাম, সেগুলো যথাযথ পালন করা খুব দরকার। যেমন, স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা, নিজেকে চাপমুক্ত রাখা, নিজের জন্য একটু সময় দেওয়া, হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করা, সময়মতো খাবার ও ঘুম, প্রিয়জনদের সঙ্গে গল্পগুজব করা। এগুলো সব সময়ই করা উচিত করোনা যেন তা মনে করিয়ে দিল।
যা করবেন এবং করবেন না
আপনারা অনুগ্রহ করে ওষুধ গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করেবেন। কারণ প্রতিদিন এর চিকিৎসাপদ্ধতি আপডেট হচ্ছে। তাই অচিকিৎসক কারও পরামর্শে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তো তেমন কোনো ওষুধই লাগে না। পরবর্তী সময়ে অনেকেই আমার কাছে করোনার সময় আমি কী কী ওষুধ খেয়েছি, জানতে চেয়েছেন, পরামর্শ চেয়েছেন। আমি সবাইকেই চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি এবং ক্ষেত্রবিশেষে চিকিৎসকের কন্টাক্ট নম্বর দিয়েছি। আমি নিজে কোনো পরামর্শ দিইনি। কারণ, আমি চিকিৎসক নই।
করোনায় শ্বাসকষ্ট না হলে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। মৃদু শ্বাসকষ্ট হলেও ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আমার রুমের এক সদস্যের ২৬তম দিন পর্যন্ত মৃদু শ্বাসকষ্ট হয়েছে বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময়। তবে অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৭/৯৮ থাকায় চিকিৎসক কেবল গরম ভাপ ও ব্যায়ামের পরামর্শ দিয়েছেন। এতেই তিনি ধীরে ধীরে সেরে উঠেছেন।
অবশেষে আমরা সবাই করোনা থেকে মুক্ত হলাম। কোভিড নেগেটিভ আসার পরও আমরা আরও ১৪ দিন আইসোলেশনে থেকেছি পরামর্শ অনুযায়ী। কাউকে বিপদে ফেলতে চাইনি। করোনাকালে আমাদের বন্ধু, আপনজন, চিকিৎসকেরা দূরে থেকেও যেভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। করোনা হলে ভয় পাবার কিছু নেই। মনে সাহস রেখে, নিয়মগুলো মেনে চললে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাই আমাদের রক্ষা করতে পারবে।