করপোরেট চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল কুষ্টিয়ার তরুণ

Comments · 1470 Views

বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং খাতে কাজ করছেন অনেক তরুণ। তাঁদের অনেকেই সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের দক্ষ কর্মীদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। আয়ও করছেন ভালো। অনেকেই আবার নিজে কাজ করার পাশাপাশি অন্যকে কাজ শেখাচ্ছেন। হয়ে উঠছেন তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তা। কেউ কেউ প্রথাগত চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিংকেই বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। এমনই এক সফল ফ্রিল্যান্সার সাইফুজ্জামান শিপন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার তারাগুনিয়া গ্রামে। এখন পরিবার নিয়ে বাস করছেন রাজধানীর উত্তরায়। পেশাদার ফ্রিল্যান্সার গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে কাজ করার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন ভালো বেতনের করপোরেট চাকরি। তাঁর লক্ষ্য গড়ে তুলবেন একটি স্টার্টআপ। সম্প্রতি কথা হয় তাঁর সঙ্গে।

সাইফুজ্জামান বলেন, শিপন বলেই তাঁকে চেনেন সবাই। ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বিখ্যাত বিজ্ঞানী ড. এ পি জে আবদুল কালামের আমরা ঘুমের মাঝে যা দেখি তা স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন হলো সেটাই, যা আমাদের ঘুম কেড়ে নেয়এ কথাটি তাঁর প্রিয়। কারণ, এটাই তাঁর সফলতার অন্যতম সূত্র। তিনি মনে করেন, সফল হতে হলে স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেই স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য পরিশ্রম করার ইচ্ছা থাকতে হবে। তিনি খুব পরিশ্রম করে এত দূর এসেছেন। প্রতিদিন নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। নতুন বিষয় শিখছেন। কারণ, ফ্রিল্যান্সিং করতে হলে বা তার মতো গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ করতে গেলে নিয়মিত আপডেট থাকা খুব জরুরি। বায়ার যে ধরনের কাজ দেবে, তা না পারলে তো টিকে থাকা যাবে না।

শিপনের ভাষ্য, ফ্রিল্যান্সার মানে কাজের অনেক চাপ। রাত জেগে কাজ করে ক্রেতার ফরমাশ পূরণ করা। তবে সময়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে সমস্যা হয় না। অন্তত করপোরেট চাকরির মতো নিজেকে নির্ধারিত সময়ের বেড়াজালে আটকে রাখতে হয় না। নিজের স্বাধীনমতো কাজ করা যায়। এ জন্য তিনি চাকরি ছেড়েছেন। যখন তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন, তখন তাঁর আয় ছিল মাত্র ৩৫ মার্কিন ডলার। এখন মাসে এক হাজার ডলারের বেশি আয় করছেন তিনি।

শিপন বলেন, আমার চেয়ে অনেকেই এখাতে বেশি আয় করছেন। কিন্তু তিনি যেভাবে চাকরি ছেড়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য ফ্রিল্যান্সিংয়ে এসেছেন, তা সবাই করার সাহস পায় না। কারণ, চাকরিতে মাসের শেষেই বেতন চলে আসে। কিন্তু ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক সময় আয়ের নিশ্চয়তা থাকে না। কোনো মাসে হয়তো অনেক আয়, আবার অনেক দিন বসে থাকা। তাই ফ্রিল্যান্সারদের অর্থের ব্যবস্থাপনাও ঠিকভাবে জানা প্রয়োজন। নিজের প্রতি খেয়াল রাখা, নিজেকে ভালোবাসা প্রয়োজন। সবচেয়ে প্রয়োজন ফ্রিল্যান্সিং শিখে, দক্ষ হয়ে তারপর এ পথে হাঁটতে শুরু করা। তা না হলে হোঁচট খেতে হবে। উদ্যম চলে যাবে। দুদিন পর ফ্রিল্যান্সিং ভালো লাগবে না। আমাদের দেশের বেশির ভাগ ফ্রিল্যান্সারের ক্ষেত্রে এ সমস্যা হয়। অনেকেই কাজ না শিখে ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটে এসে আমাদের দুর্নাম করেন। তাঁরা ক্রেতাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে পারেন না। ফলে, বাংলাদেশের নতুনদের অনেকেই কাজ দিতে চায় না। অনেক মার্কেটপ্লেসে তো বাংলাদেশের নতুন কর্মীদের অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগই দেয় না।

শিপন আরও বলেন, তিনি উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছেন। তার আগে একটি টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠানে গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে কাজও করেছেন। পড়াশোনা শেষ করে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন। গ্রাফিকস ডিজাইনার হিসেবে কাজ করা অবস্থাতেই শিপন ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানতে পারেন। ফ্রিল্যান্সিং বা মুক্ত পেশার ধারণা ভালো লেগে যায়। কিন্তু তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করার আগে নিজেকে তৈরির জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। প্রশিক্ষণ নেন কোডার্সট্রাস্ট বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে। চাকরির পাশাপাশি তিনি এ বিষয়ে আরও দক্ষতা অর্জন করেন। এরপর ফ্রিল্যান্সিং কাজ করার জন্য চাকরি ছেড়ে দেন। এতে পরিবার তাঁকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। কোর্স করার সময়েই শিপন তাঁর ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারের প্রথম কাজটি পেয়ে যান। ১০ ডলারের সেই কাজ করার পর বায়ার তাঁর কাজে খুশি হয়ে ২৫ ডলার টিপস দেন। সেই ৩৫ ডলার থেকে শুরু আর এখন শিপনের আয় প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার ডলার। দুই বছরের ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে তিনি ৪০৮টি প্রকল্প শেষ করেছেন। ঘণ্টাভিত্তিক প্রকল্পে কাজ করেছেন ৬০ ঘণ্টার বেশি। নিজে কাজ করার পাশাপাশি নিয়মিত পাঁচজন ফ্রিল্যান্সারকে নিয়ে কাজ করছেন।

শিপন বলেন, গ্রাফিকস ডিজাইন যাঁরা জানেন, তাঁরা শুধু ডিজাইনের কাজ করবেন, তা কিন্তু নয়। গ্রাফিকস ডিজাইন জানলে গবেষণা, পরামর্শ, বিভিন্ন প্রকল্পের কাজে যুক্ত হতে পারেন। বিদেশি বায়ারের পাশাপাশি দেশের বাজারের ক্রেতাও পাবেন। লোগো, বিজনেস কার্ড, ফ্লায়ার, পোস্টারসহ বিভিন্ন ডিজাইন করে বিক্রি করতে পারেন। নিজের ব্যবসা খুলতে পারেন। যাঁরা এখাতে দক্ষ, তাঁদের কাজের অভাব হবে না। কিন্তু পুরোপুরি পেশাদার গ্রাফিকস ডিজাইনার হতে গেলে নিয়মিত চর্চা, কারও অধীনে শেখার মতো বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। অনলাইনে, ইউটিউবে নানা ম্যাটেরিয়ালস পাবেন। শিখতে হবে। যাঁরা সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে নেমে যাবেন, তাঁরা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারবেন না। তাই টিমওয়ার্ক করে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে ভালো হবে। প্রয়োজনে ভালো প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। দেশে বেশ কয়েকটি ভালো প্রতিষ্ঠান আছে, যারা গ্রাফিকস ডিজাইনে প্রশিক্ষণ দেয়। তবে নিজের প্রশিক্ষণ নিজের কাছেই। প্রয়োজনে আর্ট শিখতে পারেন। এ খাতের সফটওয়্যার হালনাগাদ হচ্ছে। নতুন সফটওয়্যারের সঙ্গে নিজেকে হালনাগাদ রাখতে হবে। প্রতিযোগিতার বাজারে নিজেকে এগিয়ে রাখতে পারলেও চাকরি ছাড়ার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।

একজন গ্রাফিকস ডিজাইনার ও ফ্রিল্যান্সার হিসেবে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও বলেছেন শিপন। বিশেষ করে বায়ারের কাছ থেকে টাকা আনার বিষয়টি এখনো জটিল। আপওয়ার্ক বা ফাইভারের মতো মার্কেটপ্লেসে টাকা আনার নানা উপায় থাকলেও সরাসরি ক্লায়েন্টের কাছ থেকে টাকা আনতে ঝামেলায় পড়তে হয়। এ কারণে পেপালের মতো সেবা দেশে থাকা জরুরি। এখন পেওনিয়ার, জুম ও অন্যান্য ব্যাক সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে। পেপালের মতো সেবা দেশে চালু হলে ফ্রিল্যান্সারদের সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও পরিষ্কার নির্দেশনা থাকার কথাও বলেন তিনি।

Comments